Tuesday 22 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। তপোভাগ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়



আমি সে চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে তুমি সুর্যাস্ত দ্যাখো

একটি একটি করে পা'দুটি, উঠে আসে আমার বুকে

আমার পঞ্জরাস্থি মড়মড় করে, সুখে

আমার বুক ধকধক করতে করতে

স্পন্দন পাঠিয়ে দেয়

তুমি ঋতুমতী হয়ে ওঠো

আমার রুক্ষ পরুষ বুকে তোমার আলতার দাগ আঁকা হয়





মধুক্ষরন্তি ...



নির্বাক হয়ে থাকে পৃথা। এই অগ্নিশিখাসদৃশ মুনি তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছেন। একদিন চলে যাবেন। কোথায় যাবেন? কোথাও যাবেন, কিন্তু যাবেন। পৃথাকে নিয়ে যাবেন না।

মহারাজ কুন্তীভোজের এই আবাসে প্রথম থেকেই মুনিঋষিদের আসা যাওয়া দেখে আসছে সে। তাঁরা আসেন, যেন সমগ্র পৃথিবীটিকে নিয়ে আসেন তাঁরা। তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে তার উপস্থিতিতে নানা বিষয়ে কথা বলেন তাঁরা, সে সবের মধ্যে যে কি আছে, এক অনন্ত রহস্যময় গবাক্ষ, যার মধ্য দিয়ে অসীম আকাশে দৃষ্টি প্রেরণ করা যায়। এই মুনিঋষিদের রহস্যালাপ, তত্ত্বালোচনা উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক, বিভিন্ন রাজবংশের অন্দরের কাহিনী, পথে বনে বা জনপদে ঘটে যাওয়া অদ্ভূত আশ্চর্য ঘটনা যা তাঁরা চাক্ষুষ করেছেন -- এসবের অভাবে কিভাবে থাকবে পৃথা! সর্বোপরি মুনিবর আত্রেয়। তাঁর অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যে দূরত্ব অনেকটা।

এমন কি কোন উপায় নেই, যাতে মুনির সংসর্গে সে সর্বদাই থাকতে পারে? এমন কোন উপায় কি নেই? মুনিবর থাকলেই বাকি সব থাকবে।  শিষ্যকূল, তাদের মাধ্যমে বহির্পৃথিবী, অনন্ত অপার তরঙ্গোচ্ছ্বাস --

আয়ত চক্ষুদুটি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে পৃথা। দেবদিবাকর প্রত্যহের ন্যায় ইন্দ্রজাল ছড়াচ্ছেন আকাশে। মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে মেঘের বর্ণ, কখনো সাদা, একটু পরেই সেই অংশটি হয়ে উঠলো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ, কয়েক মুহূর্ত পরে তা রক্তিম হয়ে ইঠছে। পালটে পালটে যাচ্ছে একেকটি আকার। স্তূপের ওপর স্তূপ চড়িয়ে যেন বা নির্মীত হয়েছিল কোন মন্দির, একটু পরেই তাকে দেখে মনে হচ্ছে কলনাদিনী কোন পার্বত্য স্রোতস্বিনীর তরঙ্গমালা, দুলতে দুলতে এগিয়ে আসবে এক্ষুণি --

          এরপর, বনপ্রান্তে অস্ত যাবেন ভাস্কর। পৃথার আর সে দৃশ্য দেখা হয় না। পৃথার মস্তক থেকে সামান্য উঁচু এই ছাদের প্রাচীর, আগে একটি উদ্বৃত্ত প্রস্তরখণ্ড ছিলো ছাদে, তার উপর উঠে দাঁড়িয়ে সে বনপ্রান্তে সূর্য ডুবতে দেখতো। সেই পাথরটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

আজ এমন একটি দিন, আজও দেখতে পাবেনা? পৃথার চোখ ব্যথা করে। চোখের ওপর পক্ষ্মের ভেতর থেকে, নিচের পক্ষ্মের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে তারা, যারা অনেকক্ষণ বাঁধে আটকে ছিলো। বাঁধ, আর মানছেনা।

সযত্নে সে গোপন করে উদগত অশ্রু। যেহেতু মুনি পশ্চিমাস্য, পৃথাও পশ্চিমে দৃষ্টি রেখেছে, তাই তার পক্ষে সুবিধা হয়। কয়েকটি অবাধ্য বিন্দুকে আটকানো যায়না, তারা কপোল বেয়ে নেমে যায় অনির্দেশ্যে। গোপন হস্তে চক্ষু মার্জনা করে নেয় বালিকা।

-- তোমার কি কোনরূপ ক্লেশবোধ হচ্ছে পৃথে? আমাকে নির্ভয়ে বলতে পারো।

কি বলবে পৃথা। তার সব তন্ত্রী ছিঁড়ে গেছে। বাল্যকালের কথা মনে পড়ে, অনুজ বসু, পিতাকে মনে পড়ে, মাতাকে, তাদের পল্লী, সেসব কিছুই তার জীবনে নেই। কুন্তীরাজ্যের শুষ্ক আড়ম্বর, রাজনন্দিনীর মর্যাদা, এ সমস্ত ঠাঁইনাড়া হতে হতে তার মন কোথাও থিতু হতে পায়নি। এখানে যতি মুনি ঋষিদের দেখে তার মনে সুদূরের প্রতি আকর্ষণ জন্মেছে, এই ভ্রমণশীল মুনিরা যেন এক একটি রাজ্য, তাদের জানার যেন শেষ নেই! এরপর কয়েক বৎসরে তার বিবাহও হয়ে যাবে, নিশ্চয়ই কোন রাজবংশেই হবে, কেমন সে বংশ, কোন সে দেশ, কে বা জানে! কি আছে এরপর জীবনে! কোনদিকে নিয়ে যাবে জীবন তাকে। বিষণ্ণ লাগে পৃথার, মুনির কথার কোন উত্তর আসেনা তার মুখে, অথচ কোন উত্তর না দিলে মুনি কুপিত হতে পারেন, তাই তাড়াহুড়োয় সে বলে -- আমি আর দিবাবসান দেখতে পাইনা প্রভূ!

-- দিবাবসান দেখতে পাওনা? কেন?

-- এই ছাদে একটি প্রস্তরখণ্ড ছিলো প্রভূ। তার উপর দাঁড়িয়ে আমি পশ্চিম দিগন্তে সূর্যদেবকে বনতলে অস্ত যেতে  দেখতাম। সেই প্রস্তরখণ্ডটি অপসারিত হয়েছে। আমার দৃষ্টি এই ছাদে ব্যাহত হয়। দিনপতিকে আমি পশ্চিমে ঢলতে দেখি, বনপ্রান্তে অস্তমিত হতে আর দেখতে পাইনা আর্য।

-- এইই তোমার দুঃখ?

-- হ্যাঁ, প্রভূ।

স্মিতমুখে কিয়ৎক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকেন মুনি। দুই তিন পল ভাবেন। তারপর উঠে গিয়ে ছাদের পশ্চিম প্রাচীরের দিকে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন। তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলেন, এখানে দাঁড়াও।

পৃথা নির্বাক, সম্মোহিত। মুনির চক্ষু মুদ্রিত। কয়েকটি কল্পান্তপ্রায় মুহূর্ত কেটে যায়। তারপর মুনি তার বুকের বাঁদিকে, হৃৎপিণ্ডের ঠিক ওপরে একটি আলতো চাপ অনুভব করেন। তার পরেই বুকের ডানদিকেও। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখেন মুনি। পৃথার দুই পায়ের স্পর্শে তিনি বোঝেন, সে কাঁপছে।

          পৃথা দুই হাত ধরে আছে প্রাচীরের প্রান্ত। অবশ্যই সে কাঁপছে, আত্মসংবরণও করছে, এবং সে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে এই অপরাহ্ন গোধূলির মতো। সে ঠিক বুঝতে পারছেনা, তার শরীরমনে এমন একটা কিছু হচ্ছে যা আগে কখনও হয়নি। নিচের দিকে সে তাকাতে পারছেনা। পরম তৃষ্ণায় পশ্চিমাকাশে দৃষ্টি গেঁথে রেখেছে।

অনুভূতি তাঁকে জানিয়ে দেয়। তিনি অপর কিছু টের পান। বুকের ওপর পৃথার কাঁপতে থাকা পা দু'টিই শুধু নয়, আরো কিছু। তিনি চোখ খোলেন। দেখেন পৃথার দক্ষিণ পদ বেয়ে তাঁর বুকে, তাঁর হৃদয়ের ওপর নেমে এসেছে রক্তিমাভ তরল। বালিকার প্রথম রজঃ! অতি পবিত্র। দক্ষিণ হস্তের মধ্যাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ তাতে ঠেকিয়ে তিনি আপন জিহ্বায় স্পর্শ করেন। তারপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তাতে স্পর্শ করে আপন ভ্রুমধ্যে তিলক কাটেন। তারপর ধ্যানস্থ হয়ে পড়েন।



 পৃথিবীর ইতিহাসে সময়, কয়েক লহমার জন্য থেমে যায়।

2 comments:

  1. অর্ঘ্য দত্ত3 November 2019 at 03:47

    ব্যাপক‌। একসঙ্গে না পড়তে পারা অবধি তৃপ্তি নেই।

    ReplyDelete
  2. ভীষণ ভালো লাগলো।এইবার এটা বই হয়ে আসুক

    ReplyDelete