Wednesday 23 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। সরোজ দরবার




গোপন গোপন খেলা

রাক্ষসটা যখন ঘরে ঢুকেই এল, তখন নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় যে, দরজাটা হাট করে খোলা।
বস্তুত দরজা খোলা পেলে তবেই কেউ ঘরে ঢুকতে পারে। কিন্তু রাক্ষসটা তো দরজাতেই থাকে। ঝোলানো। তাই তার মুখ সর্বদা বাইরের দিকে। বাইরে থেকে কেউ যদি আমাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে হিংসা করে, তবে সে যেন এই রাক্ষস দেখে ডরায়। মুখ কালো করে ফেরে। এই ভেবে রাক্ষসটাকে দরজায় ঝুলিয়েছিল পিয়ালি। ঘরে এসে ঢোকার কোনও চান্স তার কোনওকালেই ছিল না।
কিন্তু রাক্ষসটা সত্যিই এখন ঘরে এসেছে। বসেছে বিছানায়। আমার ঠিক পাশটিতে।
তাকে দেখে আমি অবশ্য ভয় পাইনি। কিন্তু পিয়ালির উপর খুব রাগ হল। এত বেখেয়াল হলে চলবে! ঠিক দরজাটা খুলে রেখে বেরিয়ে গেছে। রাক্ষসটা তখন দেখল, সে যে-কোনও দিকেই যেতে পারে। তবে বাইরের অপশনটা তো সব সময় থাকেইভিতরে গেলে মন্দ হয় না। এই ভেবেই ভিতরে চলে এসেছে। তাও চেনা রাক্ষস। তাই আমার ভয়ডর লাগেনি। কিন্তু অচেনা মানুষজন ঢুকে পড়তে পারত। আজকাল যা সব উপদ্রবের গল্প পড়ি কাগজে। কী থেকে যে কী হয়ে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। রাক্ষসটা সেদিক থেকে আমাকে নিশ্চিন্তই করল। কারণ ওর মুখ, মুখের বিকৃতি, মুখে লেগে থাকা রং— সবটাই আমি চিনি।
তবে তাকে জ্যান্ত দেখে, এই মুহূর্তে আমার ব্রেখটের কবিতাটা মনে পড়ল। মনে মনে আমি দু’বার আওড়ে নিলাম। লাইন বাই লাইন নয়। ছেঁড়া ছেঁড়া। সেই যে দেওয়ালে রাক্ষসের মুখোশ হয়ে ঝুলে থাকার কষ্ট ইত্যাদি।
কিন্তু এবার কী হতে পারে? যেহেতু আমার ভয় করছে না, তাই আমি সম্ভাব্য পরিণতির দিকে মন দিই। এমন হতে পারে যে, রাক্ষসটা আমাকে মেরে ফেলল। কিন্তু ওর হাত-পা নেই। ও তা পারবে কী করে! মানে, মারতে এলেও আমার বাধার মুখে দাঁড়াতে পারবে না বলেই, আমার মনে হল।
তাহলে হয়তো এমনটা হবে যে, ও ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় আমাকে বদলে দেবে। মানে ও নিজে ‘আমি’ হয়ে যাবে। আর আমাকে রাক্ষস করে ঝুলিয়ে দিয়ে আসবে দরজায়। পিয়ালি বাড়ি ফিরে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পাবে না। হয়তো রাক্ষসটার সঙ্গেই থাকতে শুরু করে দেবে।
এসব হতে পারে। না-ও হতে পারে। মোট কথা এই পরিণতি আমার মনে ধরল না। আমি রাক্ষসকেই তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরকম হুট বলতে ঘরে যে ঢুকে পড়লে, তুমি কী চাও?’
রাক্ষসের মুখের রেখা একটু একটু বদলাল। তারপর বললে, ‘কিছুই না। কাঁহাতক আর ঝুলে থাকা যায়। তাই একটু বসতে এলাম। এসো, দু’জনে বরং একটু গল্প করি।’
আমি বললাম, ‘তুমি রাক্ষস। তোমার সঙ্গে আমি কি গল্প করব?’
সে বলল, ‘তাতে কী! আমিও তো চোখ খোলাই রাখি। ঘুমোই না। অনেক কিছুই দেখি যা তুমি দেখতে পাও না। সেসব নিয়ে দিব্যি গল্প হতে পারে।’
আমি এবার হেসে ফেললাম। সে ভারী বিরক্ত হল। তার সারা মুখে এই প্রশ্নই ফুটে উঠল যে, আমি হাসছি কেন? তা বুঝতে আমার দেরি হল না। আমি বললাম, ‘আরে ভাই, চোখ খোলা রাখলেই কি আর সব দেখা যায় সব সময়? নাকি সব দেখতে দেওয়া হয়! আমরা তাই-ই দেখি, যা আমাদের দেখানো হয়।’
এবার সে হাসতে শুরু করল। আর আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। স্বভাবতই আমার মুখেও প্রশ্ন ছেয়ে গেল। যে, এত সিরিয়াস একটা কথায় হাসির কী হয়েছে? রাক্ষস বেশ বুদ্ধিমান। সে চট করে আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, ‘দেখা বা দেখানো তো আলাদা কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সব দেখতে চাই? নাকি যা যা আমরা দেখতে চাই, তাই-ই আমাদের দেখানো হয়। দোষটা তাহলে কোথায়! দেখানোয়, নাকি দেখতে চাওয়ায়?’
আমাকে এবার থমকে যেতে হল। কারণ, এর পালটা উত্তর দেওয়া সহজ নয়। আমার হঠাৎ ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির সুচিত্রা সেনকে মনে পড়ে গেল। উত্তমের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ পায় ফুল, কেউ চায় ঢিল’। উত্তমেরও আর বলার কিছু ছিল না তখন।
আমাকে চুপচাপ দেখে রাক্ষসই বলল, ‘যেমন ধরো, তোমাদের কমপ্লেক্সের সেক্রেটারি রাতে যে একটি মেয়েকে গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে আসে, সে তো তোমরা অনেকেই দেখেছ।’
‘দেখেছি
‘আর, দেখে কী কী ভেবেছ?’
‘যা-কিছু ভাবা স্বাভাবিক। একজন বিবাহিত মধ্যবয়স্ক মানুষের ঘর থেকে রাতবিরেতে একজন মহিলা বেরোলে যা-যা ভাবনা আসে, তাই তাই-ই ভেবেছি। ওঁর স্ত্রী তো শুনছি, আর একসঙ্গে থাকতে চান না।’
‘সে নয় আলাদা কথা। কিন্তু কখনও কি দেখেছ, গেটের ওপার থেকে মেয়েটা কী করে বাড়ি ফেরে?’
‘না, তা দেখিনি। অত কৌতূহল থাকা ভালো নয়। তাছাড়া অত রাতে তো আর হেঁটে ফিরবে না। হয়তো, ওলা-উবর ডেকে ফেরে।’
রাক্ষস ঘাড় নাড়ে, দু’দিকে। অর্থাৎ, না। তারপর সে বলে, ‘মেয়েটা গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে। তোমাদের সেক্রেটারি টা-টা করে। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সুড়ুৎ করে ঘরের দিকে চলে আসে। তারপর মেয়েটা স্রেফ উড়ে যায়।’
‘উড়ে যায়!’
‘যায় তো।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘আমি তিনতলার জানলা থেকে রোজ দেখি, মেয়েটা উড়তে উড়তে ফিরে যাচ্ছে।’
আমি বলি, ‘তোমার মতিভ্রম হয়েছে। ওরকম কিছু হয় না। তুমি স্রেফ কল্পনা করছ।’
এ-কথা বলে ফের আমি চুপ করে যাই। কারণ আমি বুঝতে পারি, আমি যা বললাম, তাতে এই রাক্ষসের কল্পনাশক্তির ক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু তাহলে আমি মানুষ হয়ে, এটা ভাবতে পারলাম না কেন? নাকি সত্যিই অনেকেই এরকম উড়ে যায়। আমরা কেউ দেখতে পাই না। অন্তত আমি পাই না। রাক্ষস নিশ্চিত কিছু ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারী, তাই সে এই পৃথিবীটা দেখতে পায়অথবা, এমনটা হতে পারে, মেয়েটা আমাদের দেখায় যে সে হেঁটেই ফিরছে। আসলে সে উড়েই ফেরে।
আমার সব যেন গুলিয়ে গেল। আমি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।
কতক্ষণ চুপ করে ছিলাম জানি না। আচমকা আমাদের দরজাটা খুলে গেল। আর ঘটনাটা ঘটল।
আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, সামনে পিয়ালি দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে।

২)

ডাক্তার বারবার করে পিয়ালিকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘ম্যাডাম এরকম হ্যালুসিনেশন আপনার কবে থেকে হচ্ছে?’
পিয়ালি মৃদু কিন্তু দৃঢ়স্বরে জানাল, ওটা হ্যালুসিনেসন নয়। যা দেখেছে, সব সত্যিই ঘটেছে।
এর মধ্যে আমার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। পিয়ালি সজোরে আমার মাথা লক্ষ্য করে একটা ফুলদানি ছুড়েছিল। তাতেই খানিকটা কেটে রক্তপাত হয়। তবে আপাতত সে চোট সামলে নেওয়া গেছেডাক্তার বরং বেশি চিন্তিত পিয়ালিকে নিয়ে। কারণ, এতক্ষণ তিনি জেনে ফেলেছেন, পিয়ালির ঘুম ঠিকঠাক হয়। প্রেসার একটু বাড়তির দিকে, সেটা সাময়িক উত্তেজনায়। কিন্তু কেন তার এরকম হ্যালুসিনেশন হল, তার কোনও বোধগম্য ব্যাখ্যা তিনি পাচ্ছেন না।
পিয়ালিকে বাইরে পাঠিয়ে আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনি ওঁকে অন্য ডাক্তার দেখান। আজ অল্পের উপর দিয়ে গেছে। বড়ো কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তারপর ফিজ মিটিয়ে দিয়ে বাইরে এসে একটা রিকশা ধরলাম। পিয়ালি আমার পাশেই বসে। চুপচাপ। কিছুই বলছে না। আমিও কিছু বলতে পারলাম না।
একটু পরে খেয়াল করলাম, আমি গুনগুন করছি, ‘কার মিলন চাও বিরহী...’
হঠাৎ এই গান। তাও আবার রাক্ষসের সঙ্গে দেখা হওয়ার মতো একটা বিদিকিচ্ছিরি দিনে! নিজেরই গান নির্বাচনে অবাক হয়ে আমি থেমে গেলাম। আর দেখলাম, পিয়ালিও বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কারও মুখে কোনও কথা নেই। শুধু রিকশাওলা বলল, ‘এই সবুজ রঙের বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়াব তো?’

৩)                                           

রাত যে কত অদ্ভুত হয়, তার ইয়ত্তা নেই। কোনও লেখক যদি এইসব রাত বর্ণনা করতে চান তবে মনে হয় পেরে উঠবেন না। নয়তো রগরগে ইরোটিক কিছু হয়ে উঠবে। সব রাত লেখা যায় না। যাইহোক, তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আজকের এই রাতে আকাশে চাঁদ ছিল কি না জানা নেই। খেয়াল করিনি। বাতাস বইছে কি না, তাও মনে রাখিনি। আমরা। আমি আর পিয়ালি। অথচ কী রোম্যান্টিক একটা রাত এসেছে আমাদের জীবনেআমরা পরস্পরপরকে আদরে আদরে পাগল করে তুলছিলাম।
এত আদর, শেষ কবে দু’জন দু’জনকে করেছি মনে পড়ে না। দু’জনের নগ্নতা যেন ঠান্ডা জলের মতো। আমরা গণ্ডুষ ভরে তা পান করতে থাকি। অল্প অল্প চুমুকে। একবার, দু’বার। এরকম বহুবার। মনে হয়, একাধিকবার আমরা সঙ্গমে রত হচ্ছিলাম। অথবা একবারেরই দীর্ঘ সঙ্গম চলছিল। বেশ দীর্ঘ। অন্তত আমাদের অভিজ্ঞতায় এরকম দীর্ঘক্ষণের কোনও স্মৃতি নেই।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ক্লান্ত পিয়ালি এখন শুয়ে আছে। নিরাবরণ। এখনও। পোশাক গায়ে টেনে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এবং আমি বুঝতে পারি, ও ঘুমিয়েই পড়েছে।
এবার নিরাবরণ আমি, বিছানা ছেড়ে উঠি। জল খাই। তারপর ভাবি, এই দীর্ঘ সঙ্গমের কারণ কী? এমনিই। যে কোনও সম্পর্কেই এমন হয়! নাকি এই রাক্ষসের দর্শন পেয়ে পিয়ালি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। আমার নগ্নতা হাতড়ে হাতড়ে, আমার সঙ্গে সঙ্গমে মাততে মাততে সে বুঝে নিতে চেয়েছিল, আমি আমিই। আমি আগে যা ছিলাম তাই-ই। কোথাও কোনও ফারাক নেই।
ওর অবশ্য এরকমটা পরখ করে নেওয়ার পিছনে কারণ আছে। ডাক্তারের চেম্বারে ও একটা কথাও বলেনি। ফেরার পথেও না। ফিরেও সারাক্ষণ গুম হয়েছিল।
তারপর যখন আদরের মুহূর্তগুলো শুরু হল, কোনও একসময় ওর নরম শরীরে মৃদু চাপ দিতে দিতে আমি বলেছিলাম, ‘পিয়ালি তুমি আমাকে ফুলদানি ছুঁড়ে মারলে কেন?’
পিয়ালি বলল, ‘তোমাকে তো মারিনি
আমি বললাম, ‘কেটে আমার রক্ত অবধি বেরিয়ে গেল। আর বলছ, আমাকে মারোনি।’
পিয়ালি আমাকে আরও জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঘরে ঢোকার পর আমি কী দেখেছিলাম জানো?’
বললাম, ‘কী?’
ও বলল, ‘একটা রাক্ষসকে তুমি তোমার ভিতর থেকে বের করছ। আবার ঢুকিয়ে নিচ্ছ। যেন তুমি আর রাক্ষসটা এক হয়ে যাচ্ছ।’
‘তখনই তুমি মারলে?’
‘না, রাক্ষসের মুখটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল।’
‘তারপর?’
‘আমি ছুটে গিয়ে দরজায় দেখলাম। দেখলাম, সেখানে মুখোশ যেমন ঝোলার তেমনই ঝুলছে।’
‘তাহলে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারিনি। আমার শুধু মনে হয়েছিল, রাক্ষসটার হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর দরকার। আমি তৎক্ষণাৎ ফুলদানিটা হাতে তুলে নিয়ে রাক্ষসটার মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম।’
‘কিন্তু ওর গায়ে তো লাগলই না।’
‘লাগবে কী করে? আমি তো দেখলাম, রাক্ষসটাকে বাঁচাতে তুমি তক্ষুণি ওটাকে তোমার ভিতর ঢুকিয়ে নিলে।’
আমি ওর কথায় অবাক হওয়ার সময় পাইনি। কারণ পিয়ালি ততক্ষণে আমাকে ফেলে আমার উপর চেপে বসেছে। এবং আমিও পুরোদমে সেই রতিক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছিলাম।
কিন্তু এখন এইসব শেষে, ঘুমন্ত পিয়ালিকে পাশে রেখে আমি ভাবতে বসলাম, তবে কি রাক্ষসটা এখন আমার ভিতরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে!
এ কী অদ্ভুত লুকোচুরি। আমি সেই ছোটোবেলার মতো করে একবার বললাম, ধাপ্পা। যেন ধরে ফেলেছি। যেন, যা লুকোনো তা দেখে ফেলেছি। কিন্তু কোথাও থেকে কোনও আওয়াজ এল না। আমারও আর দরজা অবধি গিয়ে রাক্ষসটাকে দেখার সাহস হল না।

৪)

পরদিন আমার ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। ততক্ষণে সংসার সচল হয়ে গেছে। পিয়ালি আমাকে সজাগ দেখে আগের মতো হাসতে হাসতে এসে বলল, ‘ব্যথা কেমন তোমার?’
আমি বললাম, ‘কমই। মনে হয় প্রায় নেইই।’
পিয়ালি বলে, ‘জানো আজ এক কাণ্ড হয়েছে।’
‘কী?’
‘সকালে উঠে দেখি দরজা থেকে রাক্ষসের মুখোশটা কে যেন খুলে নিয়ে চলে গেছে।’
আমি বললাম, ‘সে কী! কে নিল?’
পিয়ালি বলে, ‘গেছে যাকগে। আপদ বিদায় হয়েছে। ও মুখ আর দেখতে হবে না।’
আমি আর কিছু বললাম না। শুধু রাক্ষসের বলা কথাটাই এখন আমার মনে পড়ল। পিয়ালি বলে গেল, দেখতে হবে না। মানে ও দেখতে চায় না। চায় না বলেই, তাকে আর রাক্ষসটা দেখা দেবে না। বা দেখানো হবে না। কিন্তু সে দেখাই কি সব! তার মানে যে রাক্ষসটা নেই তা তো নয়। রাক্ষসটা কি হেঁটে গেল, নাকি উড়ে গেল! নাকি থেকেই গেল!
এসব প্রশ্ন করে আমি আর এই মুহূর্তে নিজেকে বিব্রত করতে চাইলাম না। দেখি চমৎকার রোদ লেগে আছে জানলার বাইরে গাছের পাতায় পাতায়
পিয়ালি আমার জন্য, চা-জল রেখে, আমাকে হাতমুখ ধোয়ার জন্য তাড়া দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। আর আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। রাক্ষসের দেখা পেয়েও অতটা চমকাইনি। এমনকী, পিয়ালির অমন পাগল আদর অবাক করলেও ততটা বিস্মিত করেনি। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, কাল রাতেই কেন অমন পাগল হল পিয়ালি! কার জন্য জীবনভরের এমন দীর্ঘ আদর তুলে রেখেছিল সে!
মনে হতেই আমি বিস্ময়ে কথা হারালাম। কারণ মুহূর্তমাত্র আগেই ভীষণ চমকে আমি শুনলাম, কথার ফাঁকেই ফাঁকেই পিয়ালি গুণগুণ করছিল সেই আশ্চর্য গান, ‘কার মিলন চাও বিরহী...’

4 comments:

  1. বেশ লাগলো।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  3. বেশির ভাগ চলতি বাংলা গল্প/উপন্যাস এবং সিনেমাতেও দেখি একটা ফর্ম্যাট ফলো করা হয়...
    মনোনশীল, সংবেদনশীল, সেনসিটিভ ছেলের তেমনই কমপ্লিমেন্টারি বান্ধবী পরিস্থিতির ফেরে যাকে বিয়ে করে, সে লোকটা মোটা দাগের। অনুভূতি কম, অন্যের দুঃখ-চিন্তা নিয়ে বেশি ভাবে না, শান্তিতে ঘুমোয়... তাতে সেই বান্ধবীর (এখন অন্যের বউ) একদিক থেকে সুবিধেই হয়, আবার সময় বিশেষে তার সেই ফেলে আসে দোসরের অভাব খুব প্রকট হয়ে ওঠে।
    মানে... এই সংসার জীবনে মহিলা সব কিছুর মাঝেই আছে (বরের কল্যাণে বিদেশেও কাটিয়ে আসবে দীর্ঘকাল), কিন্তু সময়-অসময়ে এই স্বামীর প্রতিচ্ছবিই তাকে আরও বেশি করে আর একজনের কথা মনে করিয়ে দেবে। তাকে সেই একজন যেভাবে বোঝে, সেভাবে আর কেউ বুঝবে না।

    অথচ দম্পতির মধ্যে স্বামীও সমান সেন্সিটিভ হ'তে পারে। তার ওই ঘুমের মধ্যেও একটা চিন্তা থাকতে পারে। খবরের চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখও রান্না ঘর বা বারান্দার দিকে চলে যেতে পারে। তাকেও সেভাবে বোঝার চেষ্টা, বা তার অনুভূতিকে চেনার মত দোসর... দরকার হতে পারে। সেই দৃষ্টিকোণের লেখার একটা আলাদা জায়গা থেকে।
    এখানে পিয়ালির সত্ত্বা বা মানসিক স্তরগুলোকে এক্সপ্লোর করার ইচ্ছেটা তার স্বামীর আছে। পিয়ালি হয়ত সব সময় সবটাও বুঝতেও পারবে না। টেরও পাবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক কথা জয়দীপদা। আমার ধারণা, দুটো মানুষ সে যতই সম্পর্কের গাঢ়তায় মিশে থাক না কেন, কিছুতেই পরস্পরের সমগ্রকেই মান্য করতে পারে না। খানিকটা তৃপ্তি আর অতৃপ্তি থেকে যায় এই হিসেবে। দুজনের পারস্পেক্টিভেই এটা সত্যি। সেখান থেকেই কে যে কখন কার বিরহী হয়ে ওঠে বোঝা যায় না! এই জায়গাটা থেকে ধরতে গেলে, নিজেরও ভিতরকার অন্তত দুটো দিক তো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে একটা লেগে আছে, আর যে একজন লগ্ন নয়। এইসবই ঘুরপাক খেয়েছিল সম্ভবত পিয়ালীদের মাথায়। :)

      Delete