Sunday 27 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। অনুপম বলছি



যে কথাগুলো এই মুহূর্তে মাথায় আসছে


মনে করুন একটা শব্দ- ‘কজবকফ্বলজফগজগ্লহদ’। এই শব্দের কোনো অর্থ নেই। কেন নেই? কারণ এই শব্দে ব্যবহৃত বর্ণ এবং অক্ষরগুলো কোনো মানবিক নিয়ম, বা সামাজিক বিধি, বা সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলার ধার ধারছে না। কম্পিউটারের কিবোর্ডে আপনার আঙুলগুলো যদি র‍্যান্ডমভাবে কিছু টাইপ করে, তাহলে এমন স্বাভাবিক শব্দ উৎপন্ন হয়। কিবোর্ডের উপর দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেলেও এটা হতে পারে। একটা অবোধ বাচ্চা যদি আপনার কোলে বসে খেলার ছলে টাইপ করে, এই একই ব্যাপার ঘটবে। এই শব্দকে যেহেতু ভুল বলা যায় না, ঠিক বলা যায় না, আপনি সেটাকে কোনো গুরুত্ব দেবেন না, সেভ করবেন না। অথচ, এই শব্দটা প্রকৃতির বাইরে নয়, কৃত্রিম নয়একরকম যুক্তি থেকেই সে জন্ম নিয়েছিল। এটা যে একটা শব্দই, এ ব্যাপারেও সন্দেহ করা চলে না। অপরিচিত শব্দ। অবশ্যই। অর্থহীন শব্দ? হয়ত তাই। কারণ এই শব্দ কোনো কিছুকেই সিগনিফাই করছে না আপনার পরিচিত ভঙ্গীতে। সংস্কৃত নয়, হিব্রু নয়, ডাচ্‌ নয়, আফ্রিকান লিপিও নয়। ‘ক’-এর পরে ‘জ’ যে এসেছে, এবং তার পরে এসেছে ‘ব’ ও ‘ক’, সেটা জাস্ট ঘটে গেছে। সিন্ধু সভ্যতার যে শিলমোহর পাওয়া গেছে, আজও নিশ্চিত নয়, সেটা সত্যিই শিলমোহর কি না। জানা যায় না, সেই লিপি সত্যিই লিপি, না কি শুধুই ছবি। জানা যায় না, যদি তা লিপিবদ্ধ ভাষা হয়, সেটা কি ইন্দো-ইউরোপীয়, না কি দ্রাবিড়ীয়।
কবিতা কী? এই প্রশ্নের উত্তর সবাই এড়িয়ে যায়। তার বদলে কবিতা কী নয়, সেটাই বলতে শুরু করেকবিতা শব্দের সরলতম অর্থ হল কবিত্ব। যেটার মাধ্যমে একজন মানুষের কবিস্বভাব প্রকাশিত হয়, সেটাই কবিতা। তা লিখিত কিছু হতে পারে, চিত্রায়িত কিছু, দৃশ্যায়িত কিছু, বা শ্রাব্য কিছু। লিখিত কিছুকেই যে আপনি কবিতা ভাবেন, সে আপনার সংস্কার মাত্র। সেই লিখিত কিছুর কাছে যাওয়ার আগে আপনি যে একটা প্রত্যাশা নিয়ে যান, এটা আপনার অভ্যাস। কবিতা বা কবিত্ব আপনার অভ্যাসের ধার ধারে না। আপনার অভ্যাসকে ধ্বংস করে দ্যায় কবিতা বা কবিত্ব। কবিত্ব কাকে বলে? সে হল কবির আত্মপরিচয়ের উদ্ভাস। কবি কাকে বলে? কবি হলেন তিনি যিনি বকবক করে বর্ণনা করেন, যিনি কু-শব্দ করেন। তিনি চালাক নন, বোকাও নন। গৃহস্থ নন, বিপ্লবীও নন। ভারতচন্দ্র রায় কবি, রামপ্রসাদ সেনও কবি। রবীন্দ্রনাথ কবি, ফাল্গুনী রায়ও কবি। অমিয়ভূষণ মজুমদার কবি, সমরেশ মজুমদারও কবি। যাঁরা কবি এবং লেখক এই দুটো শব্দকে আলাদা করে ভাবেন, তাঁদের অবশ্যই একবার মিগুয়েল দ্য সার্ভান্তেসের আগের পৃথিবীতে ঘুরে আসা উচিত। উপন্যাস এক অর্বাচীন শিল্প। প্রবন্ধও তাই-ই। কবিতার সঙ্গে উপন্যাসের প্রভেদ হীরে আর গ্রাফাইটের চেয়ে বেশি কিছু নয়। একজন লেখক কবি হতে পারেন, অথবা সাংবাদিক, এর মধ্যে কোনো তৃতীয় পথ হয় না। ভান করা যায়। কবির ভান করে প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা লাভ করা যায়, রাজকবি হওয়া যায়, বিশ্বচরাচরের সঙ্গে নিজের যোগ অনুভব করা যায় না। আত্মায় আসল মজাটাই তো পাওয়া যায় না!
গল্প কী করে লিখতে হয়, এই উত্তরও কি ২০১৯-এর কোনো লেখক বলতে পারেন? তিনি কি জানেন গল্প কাকে বলে? এই উত্তরগুলো মিলে গেলে সম্ভবত পৃথিবী থেকে গল্প লেখার শিল্প লুপ্ত হয়ে যাবে। কিছু ক্ষেত্রে পথ চলার কৌতূহলটাই সাধনার তাগিদ হয়ে থাকে, আবহমানভাবে। ভাষার ভিতরে আর বাহিরে লেখার মাধ্যমটির প্রতি প্রেমমিশ্রিত বিস্ময়বোধ হয়ে থাকে কাহিনি সৃজনের প্রেরণা।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে একবার কেউ প্রশ্ন করেছিলেন তিনি ‘নপন্দীস’-এর লেখা পড়েছেন কি না। সন্দীপন ফাঁদটা বুঝতে না পেরে উত্তর দিয়েছিলেন তিনি পড়েছেন। সন্দীপন বুঝতে পারেননি সন্দীপন উলটে গেলেই নপন্দীস জন্ম নেয়, এবং, সেটা জাস্ট ঘটেই যায়, কাচের গেলাস আছড়ে পড়ার মতোই যা কিছু জন্মায়, তার জন্মানোর অধিকার অবশ্যই ছিল, এবং তার মৃত্যুও সে সঙ্গে নিয়েই জন্মায়। ভাষার বাহির বা ভিতর বলে কিছু নেই। ধরুন একটা নাম- ‘তারাপদ’। এই নামকে যদি লিখি- ‘তা রা প দ’, সে কি কিছু বদলে যায়, শুধু অক্ষরগুলো একটু ফাঁক বজায় রেখেছে বলে? কবির নিজের স্বভাবে যে ‘তারাপদ’, সেটা যদি এই ফাঁক না মানে, তাহলে এটা স্টাইল নয়। স্টাইল উঠে আসে একজন লেখকের ব্যক্তিত্ব থেকে। কবিতায় তা অনিবার্য। যে কবির স্টাইল নেই তিনি কবিই নন। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই। যেখানে মানুষরা বাস করে, যেখানে পশুরা বাস করে, সেখানেই তিনি বাস করেন, তাহলে কী তাঁর লেখার অধিকার, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁকে লেখাতেই দিতে হয়। সেই উত্তরে তাঁর চালাকি বা বোকামি, কোনোটাই থাকলে চলবে না।
ফ্যাশনদুরস্ত লেখক জনপ্রিয় হয়, আর স্টাইলিশ লেখক কালোত্তীর্ণ হয়। কিন্তু, স্টাইল আর স্টাইল-সর্বস্বতা এক বিষয় নয়। স্মার্টনেস আর স্টাইল এক বস্তু নয়। স্টাইলের ভান বড় ভয়ানক বস্তু। একজন খুব ভাল পাঠক সিনট্যাক্স-চর্চার মাধ্যমে একরকম স্মার্টনেস আয়ত্ত করে ফেলতেই পারে। আজ যদি কোনো পাঠক নিবিষ্টভাবে অধ্যয়ন করে জীবনানন্দ দাশ, কমলকুমার মজুমদার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের প্রমিত গদ্যরীতি, এবং সেগুলোকে হাতেকলমে প্রয়োগ করতে থাকে, তাকে স্টাইলিশ বলা যাবে না। ‘তোতাবাবু’ বলা যাবে। তার লেখার বিষয় যদি তাকে লেখক হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, বোঝা যাবে, জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক লেখা-লেখা খেলায় সে মেতেছে, তার লেখার উপাদান সমাজ বা জীবন থেকে আসছে না, লাইব্রেরি থেকে আসছেস্টাইল তো সিনট্যাক্সের সপ্রতিভতায় থাকে না, স্টাইল থাকে শব্দের আড়ালে নিঃশব্দে। স্টাইলকে তার বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। লেখক কোনো ওয়ার্কশপে গিয়ে এক বা একাধিক ওস্তাদ কারিগরের কাছে নাড়া বেঁধে লিখতে শেখে না, ওটা তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে আসে, এবং জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হতে থাকেজীবনের স্বাভাবিকতাই লেখার সাবলীলতা। এখানে মনে রাখতে হবে, র‍্যাঁবোর স্বাভাবিকতা কুমুদরঞ্জন মল্লিকের স্বাভাবিকতা নয়।
‘ক’-এর ঠিক কতটা কাছাকাছি ‘জ’ এসে বসতে পারে ‘ব’ এবং ক’-কে পিছনে নিয়ে, সেটাই নির্ধারণ করে বাংলা একটা শব্দ জন্ম নেবে, না কি জন্মালেও তাকে মেরে ফেলা হবে। ওভাবে বর্গীয়-জ বসতে পারে না ‘ক’-এর পরে ‘ব’-কে পেছনে নিয়ে, ‘ফ’-এ ‘ব-কার’ দেওয়া যায় না, এবং এটাই ভাষার সামাজিক সংবিধান। সেই সংবিধান ঋষিদের জন্য নয়, বিনয় মজুমদারের জন্য নয়। যেমন, গ্রামের মাধ্যমিক কো-এডুকেশন বিদ্যালয়ে ছেলেদের এবং মেয়েদের বেঞ্চি আলাদা হয়, পাশাপাশি বসে ক্লাস এইটে লেখাপড়া করতে পারে না অমল সাঁতরা আর কেয়া তরফদার। পরে তারা যখন বাসে চেপে শহরের কলেজে পড়তে যাবে, সিটে একটু ফাঁক রেখে বসবে, যেটা বিপরীত মেরুর মানুষদের রাখতে হয়। সেটা বিধি। এবং কিছু লোক মুখিয়ে থাকেন আপনার কবিতা সম্পর্কেই আপনাকে উপদেশ দেওয়ার জন্য। আপনার কবিতা নিয়ে অন্যরা কী বলছে, এক কানে শুনুন, আরেক কান দিয়ে বের করে দিন। ওরা আপনাকে বলবে কবিতা প্রেমপত্র নয়, শব্দের জাগলিং নয়, স্বপ্নের ধোঁয়া নয়, খবরের কাগজের রিপোর্ট নয়, শব্দের সুদোকু নয়, আবেগের উদ্গার নয়। কেউই বলবে না, কবিতা কী। ওরা জানে না। জানলে নিজেরা কবিতা লিখত। আপনাকে জ্ঞান দিত না। আপনি জানেন আপনি কী লিখছেন, কাজেই ওদের কথায় আপনার এসে যায় না। অথবা, আপনি জানেন না, আপনি কী লিখছেন। সেক্ষেত্রে ওরা জানবে কী করে? জাস্ট লিখে যান, যেমন কারও অনুমতি না নিয়ে, কাউকে ইমপ্রেস করতে না চেয়ে, শ্বাস নিচ্ছেন, বেঁচে থাকছেন
আজ থেকে একশ বছর আগে, জমিদার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে একসঙ্গে আসা চলত বামুন বৌয়ের আর মাহিষ্য ঝিউড়ির, কিন্তু, পাশাপাশি বসে খাওয়া চলত না। একইভাবে ‘মাগী’ লেখা চলত, কিন্তু, ‘শাদা’ এবং ‘স্তন’ পাশাপাশি লেখা চলত না। এটাই সামাজিক নিয়ম ছিলযা বদলায়। কিন্তু, আবার একটা নিয়মই এসে তার জায়গা নেয়। আজ বদলেছে। আজ এই ২০১৮ খৃস্টাব্দে বামুন বৌ আর মাহিষ্য ঝিউড়ি পার্কস্ট্রিটের কফিশপে পাশাপাশি বসে বিফ্‌স্টেক খাচ্ছে, কারণ এটাই এখনকার নিয়ম, সমাজের বিশেষ ক্ষেত্রে অন্তত এই নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। এতে কবিতার সঞ্চার হয়নি। গদ্যেরই বিবর্তন হয়েছে। সমাজ গদ্যে চলে, কবিতায় চলে না। যখন দুটো মানুষ সামাজিক বিধান ও প্রত্যাশা অনুসারে সম্পর্কযুক্ত হয়, সেটা গদ্যের সম্পর্ক, এবং স্থিতিশীল, সমাজের পক্ষে স্বস্তিকরযখন সেটা হয় না, সম্পর্কটা কবিতায় গুণময় হয়, এবং অস্থিতিশীল, সমাজ চটে যায় আনন্দ, উল্লাস, পুলক ইত্যাদির সঙ্গে স্থিতিশীলতাকে ঘুলিয়ে ফেলা কিন্তু এখানে চলবে না। স্থিতি থেকে সর্বদাই ক্ষয়ের সূচনা হয়। বর্তমান বাণিজ্যসফল কবিতায় সেই ক্ষয়ের চিহ্ন খুবই স্পষ্ট। বাণিজ্য-অসফল উপন্যাস সাহিত্যেও সেই ক্ষয়ের দাগ দেখা যায়, যখন আজও বিংশ শতাব্দীতে হদ্দ হয়ে যাওয়া কেতপিপাসু আভাঁ গার্দ কারও কারও লেখায় মাথা চাড়া দ্যায়। স্টাইলিশ হওয়ার এই মেকি দাবি খবরের কাগজের ভাষার চেয়েও মর্মান্তিক। যারা কবিতা লেখা মাঝপথে ছেড়ে উপন্যাস লিখতে আসে, কবিতায় আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের কারও কারও হাতে উপন্যাস নামক বস্তুটির অশেষ নিগ্রহ হয়, যদিও কিছু পরিমান হাততালির অভাব তাদের কপালে হয় না, ভাষার নিগ্রহকে কিছু কিছু লোক হিন্দি সিনেমার রেপসিনের মতোই এনজয় করেন।
সাহিত্য, যা কি না সমাজের দর্পণ, সে খবরের কাগজ নয় কেন? কারণ সে সম্পর্কের ও দূরত্বের চিত্রকে তার কাচে মুহুর্মুহূ ধারণ করে, কখনও ব্যক্তির, কখনও শব্দেররবীন্দ্রনাথ যখন লিখলেন ‘বাঁকা জল’, সুকুমার রায় যখন লিখলেন ‘অ্যাঁকাচোরা শহর’- তখন কী হল? এমন দুটো শব্দ পাশাপাশি এসে বসল, যাদের বসার কথা নয়। মুসলমান মেয়ের হাত ধরে যেন হিন্দু ছেলে পালাল লক্ষ্ণৌ ছেড়ে পুরনো দিল্লির দিকে। তাদের সংসার কেমন হবে? কী হবে তাদের পরিচয়? সামান্য মানুষ তারা, শাহরুখ খান আর গৌরী তো তারা নয়! সমকালীন জনগণ মানবে কেন! অবাক হবে। ক্রুদ্ধ হবে। আঘাত করবে। দুটো মানুষের সামাজিক দূরত্ব, এবং দুটো শব্দের সাহিত্যিক দূরত্ব এভাবেই সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে যদি ব্যর্থ হয়, পূরণ করতে যদি অস্বীকৃত হয়, প্রথমে তারা বিস্ময় ও অপছন্দ জাগায়, লোকে তাদের নিয়ে বিচলিত বোধ করে, তারপর তাদের কালক্রমে অভ্যাস করে নেয়। তাদেরই বিধিনিয়মের অন্তর্গত করে নেয়। যেমন, গৌতম বুদ্ধ হয়ে গেলেন নবম অবতার। সেটা তো তিনি মোটেই হতে আসেননি, তাই না? আর অরসিক পাঠক চান না অস্থির সাহিত্যকর্ম। তিনি চান তাঁর অভ্যাস অবিঘ্নিত থাকুক। বছরে একবার শারদীয় ‘দেশ’ কিনবেন বা ‘নবকল্লোল’, এবং সেটা ভাঙিয়েই নিজেকে ড্রইংরুমে এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বইপোকা বলে দাবি করবেন।
প্রত্যেক প্রজন্মে ভাষার বিশৃঙ্খলার মাত্রাটা বদলে যায়। এ কারণেই সিনিয়র খ্যাতিমান কবিলেখকদের গল্প-কবিতা পড়তে গিয়ে তরুণ কবিলেখকরা প্রায়ই অম্লমধুর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। নিজের অভিজ্ঞতা আর অবস্থান থেকে এ নিয়ে কিছু বলছি। কমবয়সী উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবিলেখকদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সিনিয়র কবিলেখকরা দুটো পন্থা নেন। এক, তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন থাকবেন, আপনার অনেক চেষ্টাতেও তিনি একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই আপনার গল্প বা কবিতা আর পড়বেন না, পড়লেও একটা শব্দ উচ্চারণ করবেন না, অপেক্ষা করবেন আপনার ফুরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেরদুই, তিনি আপনার লেখা পড়বেন, প্রচুর মতামত দেবেন, অঢেল প্রশংসা করবেন, দু-চারটে লাইন বা শব্দ বদলাতে বলবেন, নিজেদের রাস্তায় এনে আপনার লেখা ছাপবেন, গল্প বা কবিতা উৎসবে ঢোকার ফাঁক করে দেবেন, এবং এই ফাঁকে আপনার আত্মার একটা নিরপরাধ অংশে নিজেকে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেবেন, যখন আপনি নিজে কিছুটা উন্নতি করবেন এঁরাই তখন বিমুখ হয়ে আপনার সম্পর্কে কটুক্তিও করবেনআর একদল আছেন, তাঁরা সংখ্যায় অতি অল্প, তাঁরা বয়সের ধারণার উপরে, চিরতরুণ, সাহিত্যের পিপাসার্ত পাঠক, লেখার পাশাপাশি প্রচুর পড়েন, কিন্তু তাঁরা প্রতিষ্ঠিত নন, আপনাকে কিছু পাইয়ে দিতে পারবেন না, লেখা ছাড়া কিছু বোঝেননি বলে নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননিতাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে আপনার লেখার কল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, আগে আপনাকে বুঝতে হবে, আত্মা-ছিনতাইকারী এবং তৃষ্ণার্ত মানুষের পার্থক্যটা। কোন প্রশংসা আপনার প্রাপ্য, আর কোনটা আপনাকে কিনে নেওয়ার দাম, আগে বুঝতে হবে।
কিন্তু ‘কজবকফ্বলজফগজগ্লহদ’-এর কী হবে? সে কি অভ্যাস দাবি করে? তার মধ্যে কি আদৌ কোনো ষড়যন্ত্র আছে? অথবা, রসের প্রতিশ্রুতি আছে? এই অদ্ভুত শব্দের মধ্যে রস পাওয়া দুষ্কর। অহৈতুকি রসের সঞ্চার ঘটলেও ঘটতে পারে, যেমন বাচ্চাদের অর্থহীন ভাষা বা মাতালের ভাষায় আমরা রগড় পাই। সেটা সাহিত্যের ‘সূক্ষ্ম’ আবহাওয়ায় খুব মানানসই উপভোগ আদৌ নয়। সত্য-শিব-সুন্দরের কোনো আভাস এই শব্দ দিচ্ছে, এমন দাবি করা যায় না। যদি আপনি এমন একটা শব্দকে ক্ষমা করে দেন, বুঝতে হবে আপনি বৈদান্তিক মানব, পাথরের টুকরো আর আপেলের খণ্ডের মধ্যে ভেদ করেন না। কিংবা, আপনি কবি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নেওয়ার রস পাথরের মধ্যেও থাকে, নিংড়ে নেওয়াটা জানতে হয়, এটা অনস্বীকার্য। যদি বলেন, এখানে ব্যাপারটা রসের আলোচনার নয়, মূল কথাটা হল সম্ভাব্যতার, তাহলে বলি ‘ক’-এর পরে ‘জ’ যে ‘ব’ এবং ‘ক’-কে নিয়ে এসে বসবে, এটার কোনো আভাস এই বিদঘুটে শব্দটা টাইপড্‌ হওয়ার আগে দূর দিগন্তেও ছিল না, কিন্তু, সম্ভাবনা তো ছিলই। শব্দটা কেওটিক। বর্ণমালায় বাংলা, এবং অতদূরই। এই শব্দকে কাটাছেঁড়া করে, মন্থনের মাধ্যমে অনেক কিছুতেই পৌঁছনো যায়, যেমন সামাজিক, তেমনই অসামাজিক। শব্দের সঙ্গে শব্দের কোষ্ঠী মিলিয়ে রেজিস্টার্ড বিবাহ যিনি ঘটান তাঁকে কবি বা লেখক বলা যায় না, শব্দের সঙ্গে শব্দের অবৈধ মৈথুন যিনি ঘটান তিনিই লেখক দুটো শব্দ যখন সমাজ সংসার থেকে পালিয়ে পাশাপাশি শুয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে কবিতা বা আখ্যানের জন্ম হয়।
আজ যদি কোনো প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার করতে বসেন, সেখানে বুঝতে হয় সেটা ডানদিক থেকে বাঁদিকে আসছে, না কি বাঁদিক থেকে ডানদিকে যাচ্ছে। সেটা বোঝা যায় তাম্র বা মৃৎফলকে লাইনটা কোনপাশে স্বচ্ছন্দ আর কোনপাশে চেপে যাচ্ছে, সেই থেকে। একইরকম চিহ্ন কতগুলো আছে দেখতে হয়। সেগুলো কত ঘনঘন ব্যবহৃত হচ্ছে দেখতে হয়। যত বেশি পুনরাবৃত্তি হবে বিশেষ কিছু চিহ্নের, ভাষাটা তত সহজে উদ্ধার করা যাবে। স্যার আর্থার কন্যান ডয়েলের ‘The Dancing Men’ নামক গল্পে এই পাঠোদ্ধারের প্রণালী মহামতি শার্লক হোমস প্রয়োগ করেছিলেন। এই পুনরাবৃত্তি যেটা করে, ভাষার মধ্যকার বিশৃঙ্খলা কমিয়ে দ্যায়। যেমন ‘রমাপতি’ শব্দটার চেয়ে ‘কলকাতা’ অনেক সুশৃঙ্খল শব্দ, কারণ ‘রমাপতি’-র মধ্যে একই বর্ণ একবারের বেশি নেই, কিন্তু ‘কলকাতা’-র দুবার ‘ক’ আছে। ‘কলকাকলি’ তো ‘আনারকলি’-র চেয়েও বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণ, কারণ এই শব্দটায় ‘ক’ তিনবার এসেছে, ‘ল’ এসেছে দুবার। ‘রমাপতি’-র চেয়ে ‘কলকাতা’ লাবণ্যময় শব্দ, ‘কলকাকলি’ আরো বেশি, কারণ এই শব্দদুটো কানকে প্রত্যাশার স্বাদ এবং সুখ দুটোই দ্যায়। যখন অরসিক পাঠক কোনো লেখা পড়তে যান, তিনি তখনই সেই লেখার সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারেন, যখন সেটায় পুনরাবৃত্তি থাকে, লেখাটা যত কম কেওটিক হয়, যত বেশি পরিচিত শব্দ থাকে, প্রত্যাশিত বাক্যগঠন থাকে, শব্দসংস্থান যত কম বিক্ষিপ্ত হয়, অর্থাৎ, তার মধ্যে বহুত্বের সম্ভাবনা যত কম থাকে, জনসাধারণ নিশ্চিন্ত হয়, বামুন বৌয়ের পাশে যেখানে আরেক বামুন বৌ-ই বসে আরামসে লুচি খাচ্ছে
জীবনানন্দ দাশ যখন লিখছেন- “দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল”, তাঁর এই একটি লাইনের মধ্যে সময় ডিঙিয়ে যাওয়া অনেক বিশৃঙ্খলা এসে জমে। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন ‘ন’-এর কোমল অনুপ্রাস সেই বিশৃঙ্খলাকে প্রশমিত করবে, মাঠ এবং নদী তাঁর পাঠককে শান্ত করবে, কিন্তু ভুল করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় বাঙালি পাঠকের পক্ষে এই লাইন হজম করা অসম্ভব ছিল। এই লাইনের বিশৃঙ্খলা তাদের সহ্যের অতিরিক্ত ছিল। ‘নদী’-র আগে ‘নরম’ তারা সইতে পারেনি, ‘নদীর নারী’ যে আদৌ লেখা যেতে পারে তারা মানতে পারেনি, তার উপর আবার সেই নারী ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে! পক্ষান্তরে তাঁর পরবর্তীকালে লিখতে এসেও শঙ্খ ঘোষ যখন লিখছেন- “এই তো জানু পেতে বসেছি”, বাঙালি শান্তিতে লাফিয়ে উঠছে- আইব্বাস এই তো কবিতা!! কারণ শঙ্খবাবুর এই লাইনে খবরের কাগজের কোনো বাক্যের চেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা নেই, একদম মধ্যবিত্তের শোবার ঘরের মতো গোছানো, শুধু কবিতার ভাবটুকু রাখা আছে
শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন লিখছেন- “সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া” বা “আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে”- বাঙালি তাঁর কাব্যভাষায় সেই একই সুরচিত শৃঙ্খলা পেয়ে যাচ্ছে, এবং শক্তি হয়ে উঠছেন আইকন কবি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘অন্ধকার’-এর আগে ‘অনঙ্গ’ বসাতে পারতেন, সেটাও বেরসিক পাঠকের কাছে খুবই অবোধগম্য প্রয়োগ, কিন্তু, অসহনীয় নয়, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক বেহাসবিও হয়ত হয়েছেন, মাতাল হিসেবে কিংবদন্তি হয়েছেন, কিন্তু, জীবনানন্দ দাশের মতো ‘মাছ’-এর আগে ‘নির্জন’ তিনি বসাতে পারতেন না
শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাঠকের কবিতাপিপাসা মিটিয়েছেন। কিন্তু, কবিতা কি আদৌ তৃষ্ণার জল? না কি, সে স্বয়ং পিপাসা? যতই জীবনানন্দ অনুবাদ সাহিত্য আর মৌলিক কবিতার ধারণাকে ঘেঁটে দিন, বাংলা কবিতায় ইউরোপিয়ান-আমেরিকান অবক্ষয়ের সূচনা করুন, বাংলা কবিতা ব্যাপারটাকেই মুছে ফেলার জায়গায় নিয়ে গিয়ে থাকুন, জীবনানন্দ দাশের পিপাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা মাত্রএবং, আশা করি কেউ দ্বিমত হবেন না, কবি হিসেবে সমকালীন সমাজের মাথা পায়ের তলায় লুটিয়ে নেওয়ার আশা জীবনানন্দ দাশ যদি করতেন, গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে নিজের ভুলই তাঁকে আবিষ্কার করতে হত, যদি ট্রামে কাটা না পড়তেন, পঞ্চাশের দশকের কবিরা তাঁকে অনুসরণ করেই সামাজিক সফলতায় তাঁকে মাড়িয়ে যেতেন। বেঁচে থাকতে থাকতেই জনপ্রিয় কবি হতে গেলে কবিতাকে কমিয়ে নিতে হয়, অথবা, নোবেল প্রাইজটা পেতে হয়, অন্যথায়, বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্রকে ঈর্ষা করতে হয়, প্রায় সমবয়সী বুদ্ধদেব বসুর বদান্যতার উপরে নির্ভর করতে হয়।
আপনার কবিতায় আপনাকেই ঈশ্বর হতে হবে। আপনার গল্পে আপনাকে ভগবান হতে হবে। ব্রহ্ম ঈশ্বর হন যখন তিনি মায়ায় প্রবেশ করেন, এবং সৃষ্টি স্থিতি বিনাশ নিয়ে খেলা করেন খেলার আনন্দে। কখনও আপনি আপনার কবিতার এনট্রপি চরম বাড়িয়ে দেবেন, কখনও থামিয়ে রাখবেন, কখনও একদম দেবেন কমিয়ে।


12 comments:

  1. সমৃদ্ধ হলাম

    ReplyDelete
  2. What a beautiful way to convey what poetry is. Thanks for this article.

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  4. গদ্যভাষা ও কবিতার পুষ্মবনে কলমের স্টাইল বিরাট প্রাপ্তি।‌‌‌‌‌‌অনবদ্য বিশ্লেষন !

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো প্রসঙ্গে বলেছেন। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  6. কী লেখা, অসাধারণ। বহু দিন পর এমন সম্পাদকীয় পড়লাম। একটি দামি পূর্নাঙ্গ রচনা। বাংলায় লেখা উল্লেখনীয় প্রবন্ধ।

    ReplyDelete
  7. এটা সম্পাদকীয়? তাহলে ইতিহাস কার নাম? কাকেই বা পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য বলে?

    ReplyDelete
  8. অনেক জিনিস একত্রে পাওয়া গেলো; উদাহরণগুলো খাসা!! রসময়!!

    ReplyDelete
  9. prashanta guha majumder3 November 2019 at 19:28

    মুগ্ধ হলাম আবার। পাঠের শ্রম সার্থক হল। তোমাকে ভালবাসা।

    ReplyDelete