Wednesday 23 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। পরিচয় পাত্র




এলোমেলো ভাবনা

বিভূতিভূষণের জন্মদিনে এই কথাই ভাবছিলাম যে বিভূতি রচনা অবলম্বনে সত্যজিৎ আরও ছবি করতে চেয়েছিলেন, কেবলমাত্র অপু-কাহিনী নিয়েই নয়। শোনা যায় তাঁর ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’ করার ইচ্ছা ছিল, করতে পারেন নি চুনিবালা দেবীর প্রয়াণহেতু। কিন্তু আমি ভাবতে চাইছিলাম ঋত্বিক ঘটক, যিনি বিভূতি রচনা অবলম্বনে ছবি করেনই নি, তিনি ছবি করলে কেমন হত ব্যাপারখানা। যেমন ইতিহাসবিদরা অনেকসময় লিখতে চাইতেই পারেন সেই ঘটনার ইতিহাস যা আদতে ঘটেই নি। ইন্দিবর কামতেকার তাঁর এক বক্তৃতায় আলোচনা করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের ভারত আক্রমণ ও প্রবেশ নিয়ে, যে ঘটনা প্রায় ঘটে নি, কেবল তার অনুমান, তজ্জনিত উদ্বেগ আর ভীতিকর অপেক্ষাই একজন ইতিহাসবিদের পাথেয়, যা সমকালীন কাগজপত্রে ছড়িয়ে রেখে গেছে নানা মূল্যবান সংকেত।  
ঋত্বিক সত্যজিতের অনেক ছবির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, আবার অনেক ছবির করেন নি। অপু ট্রিলজির প্রথম দুই ছবি ঋত্বিকের পছন্দের, শেষেরটি তেমন নয়। ‘অপুর সংসার’ এর শেষ দৃশ্য সম্পর্কে ঋত্বিকের বক্তব্য বেশ আগ্রহোদ্দীপক। বিভূতিবাবুর ‘অপরাজিত’র শেষাংশে কাজলের নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসা, ভেঙে পড়া ভিটায় তার মগ্নচৈতন্যে পিতামহ হরিহর, পিসি দুর্গা, কতশত পূর্বপুরুষ, স্থানীয় দেবদেবীরা, অপুর কল্পনার মহাভারতীয় চরিত্রেরা এসে ভিড় করে। এই মৃতের সহিত কথোপকথন আর বিশেষ করে এই ফিরে আসা উপন্যাসের প্রচলিত ছকের বিপরীত, গ্রাম থেকে শহরে এসেই তার যাত্রা শেষ হয় নাএই হারিয়ে যাওয়া চেতনা সত্যজিতের ছবিতে না থাকা ঋত্বিককে পীড়িত করেছে, আর মৈনাক বিশ্বাস তাঁর রচনায় ঋত্বিকের নিজের ছবিতেই খুঁজে পেয়েছেন একে, এবং সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘মিথিক্যাল পাওয়ার অব রিটার্ন’ বলে। মনে রাখতে হবে এই সমালোচনা ঋত্বিকের মতো একজন ছবি-করিয়ের কাছ থেকে আসছে, কোন সাহিত্যিকের কাছ থেকে নয় যিনি উপন্যাস থেকে ছবি হলে সে ছবি মূলানুগ কিনা সেটা বিচারেই কেবল যত্নবান হবেন। যে কারণে প্রমথনাথ বিশী সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে খুবই কটু মন্তব্য করেছিলেন, তাকে উপন্যাসের কঙ্কাল বলে চিহ্নিত করেছিলেন।    
বিভূতিবাবুর রচনার নানা অংশে, উপরে উল্লিখিত অংশে তো বটেই, যা পাওয়া যায় তা আদতে মহাজাগতিকতা। বিশ্বসৃষ্টিরহস্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণীকুলের বিবর্তন, মিথের নির্মাণ সহ নানাকিছুতে তাঁর উৎসাহ গদ্যে আশ্রয় নেয়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখাপত্রে বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান-উৎসাহ সম্পর্কে নানা কথা রয়েছে। এইসব কসমোলজিক্যাল উচ্চাশা অপুর জীবনে জায়গা করে নেবে, এবং কাজলের স্বপ্ন তারা ছুঁয়ে ফেলবে। রিপন কলেজে অপুর eclectic পাঠাভ্যাস তার ইঙ্গিতবহ
পাঠের প্রসঙ্গে এইখানে আরেকবার সত্যজিতের ছবির কাছে ফিরি। ‘অপরাজিত’ ছবিতে মহাজাগতিকতাকে স্পর্শ করবার অনেক ক্ষেত্র তৈরি করেছেন সত্যজিৎ। অপুর কালপুরুষ দেখার দৃশ্যটি উল্লেখ্য, যে দৃশ্য ‘অপরাজিত’র প্রচলিত ডিজিটাল চেহারায় পাওয়া যাবে না কিন্তু ‘অপরাজিত’র অন্য একটি অংশ বরাবর আমাকে পীড়িত করেছে, সেটি অপুর শিক্ষা প্রসঙ্গ। সেখানে সত্যজিতের মন্তাজ অপুকে ঝড়ের মতো ভূগোল, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, অপু সর্বজয়াকে তার সদ্য অধীত পাঠ দেয়, ভূগোলক চেনায়, কোপারনিকান বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত করে। কিন্তু এ ছবিতে, বা এর পরের ছবিতেও অপুর মানসিক ভূগোল সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় না, কেননা তার পাঠাভ্যাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

অপু কী পড়ে? এ প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়, মঞ্চে হ্যামলেট কী পড়ে তার চেয়ে তো নেহাতই সহজ। স্তানিস্লাভ ভিসপিয়ানস্কি কথিত ‘বই হাতে বেচারা বালক’ (ঋণঃ স্বপন চক্রবর্তী) হ্যামলেট দাবী করেছিল সে শব্দের পাঠক মাত্র, আর ইয়ান কট তাঁর ‘শেক্সপীয়ার, আওয়ার কনটেম্পোরারি’ বইতে দাবী করেন আধুনিক, ষাটের দশকের হ্যামলেটের মঞ্চে পড়া উচিত মালরো, কাম্যু, কাফকা ইত্যাদি। অপুর পাঠ্যতালিকার দিকে চোখ ফেরালে দেখি সে অত্যন্ত ইর‍্যাটিক, তার পড়ার প্রকৃতি বিশৃঙ্খল। বন্ধু প্রণবের ভাষায় তা পড়া পড়া খেলা। সে নীটশের দর্শন থেকে এমার্সনের ট্রানসেনডেণ্টালিস্ট কবিতা থেকে তুরগেনেভের উপন্যাস সবই পড়ছেপড়ে রোমান ইতিহাস, পড়ে তাই যা তার মহাজাগতিক চেতনাকে পুষ্ট করবে। পড়ে বিপুল ইংরেজি কবিতা। লজিকের ক্লাসে অধ্যাপকের ভ্রূকুটির সম্ভাবনা উপেক্ষা করে সে খুলে বসে প্যালগ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারি।
অপু তুরগেনেভ একেবারে শেষ করে ফেলে, চোখের সামনে এক নতুন জগৎ, এক অপূর্ব হাসি-অশ্রুমাখানো কল্পলোক খুলে যায়। উত্তরকালে এ ধারাবাহিকতা রক্ষিত হবে তারাদাসবাবুর কলমে, যখন কাজল পড়বে দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজোভ’। সঙ্গতি রক্ষার বা কালানুক্রম বজায় রাখার জন্যেই কেবল নয় তা, আরও কিছু গভীরতা এই ঘটনাক্রমে থেকেই যাচ্ছে। পিতাপুত্রের লেখক তুরগেনেভ “যত পাপী, যত বিদ্রোহীই হোক না কেন”, দুর্বোধ্য পুত্রকেও অন্ধের মতোই স্পর্শটুকু করতে চেয়েছেন, নারোদনিকদের বুঝতে চেয়েছেন জার-শাসিত এলিটের খোলস ছেড়ে এসে। এই বহমানতার মধ্যে নিহিত পাতালছায়ার মতোই বিভূতিভূষণে থেকে যাবেন, থাকবে মিথ, এপিক, লোকজ দেবী, মৃতের সহিত কথোপকথন। কারামাজোভ পরিবারের হতভাগ্য বড়ভাই দমিত্রির পরিণতি কাজলকে তাই স্তম্ভিত করবেদমিত্রি তার বিচারসভার প্রাক্কালে স্বপ্নের মধ্যে স্তেপভূমির মধ্যে দিয়ে যাত্রায় কি এমনই নিতান্তই বাস্তব যত অলৌকিকের সন্ধান পায় না, সন্ধান পায় না সেইসব পাতালছায়াদের যারা রাশিয়ার স্তেপভূমিতে নেহাত স্বাভাবিক, দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে রাত্রির হিমের ভিতরে ছাড়া যাদের দেখা চলে না?
আমার আরেক টুকরো অনুরূপ কথোপকথন মনে পড়ে গেল। হ্যামলেটের পাঠাভ্যাস সম্পর্কে কথা বলছিলুম, স্মরণে এল স্বপন চক্রবর্তীর এ বিষয়ের একটি প্রবন্ধ, ‘কপট পাঠকঃ ফউস্টাস ও হ্যামলেট’। সেখানে এক অংশে তিনি টেনে এনেছেন রেনেসেন্স মঞ্চের বাইরের জগতেও পাঠকের “ভূতকালের আত্মাদের” সঙ্গে কথনপ্রস্তাব। ষোড়শ শতাব্দীতে ম্যাকিয়াভেলি তখন ইতালির গ্রামে স্বনির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন, এক চিঠিতে লিখছেন কেমন করে সন্ধেবেলায় পড়ার ঘরে ফিরে তিনি গায়ে চড়িয়ে নেন রাজদরবারের পোশাক, কেননা এইবারে তাঁর কথা হবে পুরনো কালের রাজসভার প্রাচীন মানুষদের সঙ্গে, তখন দারিদ্র্য বা মৃত্যু তাঁকে ভয় দেখাতে পারবে না, তিনি নিজেকে এই আত্মাদের কাছে সমর্পণ করবেন।

এই আশ্চর্য মিথ, এপিক, মৃত এবং জীবিত মানুষের সংলাপ সবসময়েই আমাদের পাঠাভ্যাসে কি বহাল থাকবে না, থাকবে না যাপনচিত্রে? আশ্চর্য নয় বরং এই যে ঋত্বিককে এই বিষয়টিই আকৃষ্ট করবে, তাঁর ছবিতে এই লস্ট কনশাসনেসের কাছে ফিরতে চাওয়া থাকবে।
আর এরই মধ্যে নিশ্চিন্দিপুরের শিশু কেবল রেলগাড়ি নয়, এরোপ্লেন দেখতে পাবে ‘অপরাজিত’র শেষাংশে। তাকে আর একটি দশক অপেক্ষা করতে হবে কেবল আর একটা বিশ্বযুদ্ধের আর জাপানী বোমারু বিমানেরসেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া এরোড্রোমে ঘুরে বেড়াবে ‘সুবর্ণরেখা’র শিশুরা। সেই যুদ্ধে জাপানীদের না হওয়া ভারত দখলের ইতিহাস লিখবেন ইন্দিবর কামতেকার।       

  

1 comment:

  1. খুব খুব সমৃদ্ধ হলাম স্যার...আপনার লেখা আমি গোগ্রাসে গিলি...

    ReplyDelete