"'ওঁ
পূর্ণমদা পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য
পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
ওঁ শান্তিঃ
শান্তিঃ শান্তিঃ’
(ঈশোপনিষৎ/
শান্তিপাঠ)
মানুষের এই চেতনাও প্রকৃতিরই দান; নির্জন বনভূমিতে গাছের তলায়
ব’সে, পাখিদের কাকলি শুনতে শুনতে, হরিণ শাবকদের কোমল চলাফেরা দেখতে-দেখতে,
পূর্ণতার বোধ ব্যতিরেকে আর কোন বোধই বা জাগ্রত হ’তে পারত? যা পূর্ণ, তার কি কোনো
ক্ষয়প্রাপ্তি নেই? অবশ্যই আছে, কিন্তু প্রাচীনকালের ঋষিগণ প্রকৃতি থেকে এ-শিক্ষাই
গ্রহণ করেছিলেন যে পূর্ণ থেকে যা-ই বিয়োগ করি না কেন, আমরা পূর্ণতেই ফিরে আসি,
পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের এই বীজমন্ত্র।"
-গৌতম
বসু
উন্মত্ত, ক্ষয়প্রবণ এই কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে যে কোন সুস্থতার আশাও
কঠিন ঠেকে যখন, আমরা আভূমি প্রণত হই সাহিত্যের সামনে এক আশ্বাসের প্রার্থনায়,
হিরণ্ময় দ্যুতি নিয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠে তখন কিছু প্রকৃত কবির অভয়মুদ্রা। তাদের
সৃষ্টির শক্তিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি অমোঘ অলৌকিকতা যাকে ব্রহ্মবাদিনী নিজের স্তবে
'কবিতা' নামের স্বীকৃতি দেন। গৌতম বসু নিয়তি নির্দিষ্টভাবেই সেই একজন। 1955 সালে
দার্জিলিং-এ জন্মগ্রহন করেছেন। উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। পেয়েছেন 'রবীন্দ্র
পুরস্কার"। এইগুলি অতি সামান্য তথ্য মাত্র । তাঁর শিক্ষার গভীরতা, রুচির
অভিজাত্য, উপস্থিতির অনিন্দ্য সৌন্দর্য দর্শনে যারা এখনও বঞ্চিত, প্রচারবিমুখ
কবি নিজেকে তাদের জন্য উন্মোচিত করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলিতে। প্রতিটি স্বতন্ত্র প্রতিটির শৈলী
থেকে। প্রথম প্রকাশিত "অন্নপূর্ণা ও শুভকাল" থেকে শুরু করে নবীনতম
"জরাবর্গ" অবধি তিনি যে স্বকীয়তার সাক্ষর দেন, তা পুরোপুরি আত্মস্থ
করতে গেলে পাঠককে তথাগত স্তবেই লীন হতে হয়। তাঁর জীবন ও সৃষ্টি, সম্পূর্ণই যেন
পূর্ণতার সাধনায় স্বয়ং এক শান্তিপাঠ। সুতরাং অতি সঙ্গত কারণেই দেশ তথা পৃথিবীর এই
ক্রান্তিকালে আমরা তাঁরই আশ্রয় নিলাম 'এই মাসের কবি' বিভাগে।
ভূমিস্পর্শমুদ্রা
গৌতম চৌধুরী
গৌতম চৌধুরী
রক্তপাতময় রণভূমির যিনি কথক, তিনি স্বীয় ভূমিনির্ধারণ-সূত্রে
এবং কথকতার সূত্রাপাতাবধি নৈর্ব্যক্তিক থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবু তিনিও কি কর্ণের রথচক্র
প্রোথিত হয়ে পড়ার দৃশ্যে পৌঁছিয়ে কিংবা রুধিরাক্ত শত শবদেহ ঘিরে বিধবাদের আর্ত রোদনধ্বনিতে
শ্রোতা বা পাঠকদের মতোই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন! অথচ যুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকেই কি ইতিহাসের
এমন এক পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল না। তাহলে আজ এই মর্মবিদারী হাহাকার কেন? কথক বলতে পারেন-
স্তব্ধ হও, বিস্মৃত হয়ো না, আমিও মানুষ, অবসানের সূর্যাস্ত - আভা আমাকেও এসে স্পর্শ
করতে পারে, শুধু দেখ, কত শান্ত ও সুন্দরভাবে আমি তাকে গ্রহণ করলাম।
গৌতম
বসু প্রণীত নয়নপথগামী কবিতাগ্রন্থের স্নায়ুতন্তুজালে সহসা প্রাগুক্ত শোকসংগীতের স্তব্ধ
অনুরণন আমাদের বিহ্বল করে। ভাবি, অব্যবহিত পটভূমি ইতিমধ্যে এমনই কী ভয়ংকরতর রূপ ধারণ করল, যে তাঁকে গেয়ে উঠতে
হয়- ' এসো অগ্নি, প্রেতলোকের হাওয়া, ব্যাধিদের অধীশ্বর এসো,/ তোমাদের পাব বলে করজোড়ে ফিরিয়ে
দিয়েছি প্রক্ষালন,/ এসো নগ্নবেশ, দুই হাতে তুলে নাও, এই কারাগার।'
অথচ কত দিন আগেই তিনি
আমাদের দেখিয়েছিলেন - ' কংসাবতী, প্রাণদায়িনী, অবিকল শকুনের ঘাড়', তথাপি এও বলেছিলেন
- ' মৃত্যুর অনেক অসভ্যতা যেখানে, সেই স্থান/ গাভীর পাদপদ্ম, স্বর্গ, নিসর্গ, অকলঙ্কিত
ধরিত্রী' ( ২১ নং কবিতা, অন্নপূর্ণা ও শুভকাল, প্র. ১৩৮৮)। বলেছিলেন - ' অবহেলার ক্ষত/
তেমনই পড়ে রইলো বলে বৃষ্টি আসবে/ মুছে দেবে, সেও মুছে যাবে গভীর শিক্ষায়' ( গোচারণ,
অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে, প্র. ১৩৯৮)। এমনকি মাত্রই কিছুদিন আগেও শুনেছি এই আহ্বান- ' অন্তরীক্ষ
হতে নেমে এসো ক্ষীণগান,... ঝরো উর্ধ্বমুখী ধোঁয়ার কুন্ডলীর অসহায় বাহুর' পরে ঝরো অবিরাম,...
লোহা মরিচার শতাব্দীর ' পরে ঝরো' ( প্রলয়, রসাতল, প্র. ১৪০৮)।
আর আজ অদ্ভুত বিস্ময়ে লক্ষ করি তাঁর নয়নপথে ভেসে ওঠে
এইসব দৃশ্য - কথা ফুরানোর দিগন্তরেখা ( পৃষ্ঠা), আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানেই যেখানে আমি/ একশত বছর পূর্বে
শুয়ে শুয়ে পুড়েছিলাম ( নিদাঘ), শেষতম মশালের আর্তনাদ ( সৈকত), দূরের ঐ অমৃতসভা ভেঙে
যাচ্ছে ( অমৃতসভা), ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকান্ড সূর্যাস্ত ( আনন্দকথা), দগ্ধভাগ্য
আমার শতপঙক্তিমালিকা/ তারা এসেছে আজ বৈতরণীর কূলে( আখর), মরণকালের তরণী ( বিসমিল্লা)।
আমাদের অভিভূত করে প্রায়শই তাঁর কন্ঠে বেজে ওঠে সর্বস্ব
হারানোর এক হাহাকার, এক মর্মান্তিক অবসান- সংগীত- মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সময় আসে ( দেবী);
দুটি চোখই আবার হারিয়ে ফেলেছি ( গোধূলি) ; আমিই বধ্যভূমি, আমিই শ্মশান( পৃষ্ঠা) ;
বাজাও রুদ্রমূর্তি, বাজাও সমাপন ( কারাগার) ; অযত্নে খনন করে ফেলেছি অন্ধকার( ত্রয়োদশী)
; গোপন কথাগুলি হারিয়েছি ( সৈকত); আমার আর্তরব কুয়োতলায় ঘোরে ( যমপুরী) ; আমার শবাধারে
অজস্র পেরেক গাঁথার/ অবিরাম ধ্বনি আকাশ জুড়ে খেলে বেড়ায় ( বইমেলার প্রথম শনিবার) ;
ম্লান হেসে এগিয়ে এসেছে আমার বিনাশ ( সুদর্শন) ; হলো না সত্যদর্শন, ভেঙে গেছে হোলিখেলা
( আনন্দ গান) ; আমি হেঁটে চলেছি অগ্নিশিখার দিকে ( আখর) ; শুভ্র চালের গন্ধ পাঠাও প্রেত
লোকে ( বদ্রীনাথের পথে)।
লোকপ্রচলিত অভিধায় ' অলক্ষণাক্রান্ত' এইসব উচ্চারণগুলি
শ্রবণে দুর্বলচিত্ত আমরা যে ভীত হয়ে পড়ি, তা অবশ্য মানুষ - গৌতমের মমত্ব বশত। কবি-
গৌতম যে অদ্যাবধি সেই রথটিতেই আসীন, সত্যভাষণের চালিকা শক্তিতে যার চলনপথ ভূমি থেকে
কিছু উর্ধ্বেই স্থাপিত - এ- প্রতীতি আমাদের প্রশ্নাতীত। এমন উক্তির প্রেক্ষিতে সরলমনা
প্রতিপ্রশ্ন তুলতে পারেন- ' কবি' কি ' মানুষ ' নন! হ্যাঁ, কবি অবশ্যই মানুষ, তবে তাঁর
মানবিক অভিজ্ঞতা ও দর্শনকে অতিক্রম করে, পরিপ্রাণিত করে, উদগত হয় কবিতার সংস্থান। কাজেই
একথা পুনর্বার স্পষ্ট করা উচিত যে, বসু-র বৈনাশিক অবলোকনগুলি, স্বগতভাষণগুলি, কোনোভাবেই
নয়নপথগামী-র কবিতার উচ্চতাকে গ্রাস করেনি। অবসানের দিগন্তস্পর্শী আভাসগুলিকে তিনি যে
মহত্ত্বের সঙ্গে, যে -সৌন্দর্যের সঙ্গে, যে - নিরুপম নিরুপায়তার সঙ্গে আবাহন ও বরণ
করেছেন, তা আমাদের বিষণ্ণ করলেও মুগ্ধ করে, এমন কি সম্মোহিতও করে, যেমন করেছে তাঁর
পূর্বাপর কবিতাগ্রন্থগুলি।
বসু-র এই অসমসাহসিকতার
স্বপক্ষে তাঁর সমগ্র কাব্যগ্রন্থটি উদ্ধৃত করা যায়। পঙক্তির পর পঙক্তি ব্যাপী এক প্রশান্ত
সুস্থির সহিষ্ণুতার কোনো অনিবার্য ভূমিশয়ানকে তিনি এক অপরূপ মহিমায় উত্তীর্ণ করেছেন।
' মাটির বক্ষলগ্ন' হয়ে যেতে যেতেও তিনি স্বাদ পেয়েছেন ' প্রাচীনা দেবী মৃত্তিকার'।
ইহলোকের গ্রন্থিগুলি যে কিছুতেই ' বিনা রক্তপাতে ছিন্ন' করা যায় না, এই মর্মজ্ঞান তিনি
উর্ধ্বলোকের প্রাত্যহিক ' ভীষণ আয়োজন ' থেকেই পান, যদিও জানেন ' এই প্রদেশ থেকে পরলোক
দেখা যায় না'। কিন্তু কবিতা গড়ে ওঠে তারও পর, প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন- ' গগনপথের কাদাজল,
গরুর গাড়ির / চাকার দাগ, মাইলস্টোন - এসব কিছুই / ধরা দেয় না চোখে'।
কবিতাপাঠের
নিবিড়তা যে- ব্যাখ্যাতীতকে আমরা স্পর্শ করি, কবিতা- আলোচনার অর্থ যদি হয় সেই ব্যাখ্যাতীতকে
শল্যশয্যায় জোর- আলোর নীচে শুইয়ে লম্বা করে দেওয়া, তবে ধিক্ আমাদের সেই অনুসন্ধিৎসা।
অন্তত নিম্নোদ্ধৃত পঙক্তিগুলির শিহরিত পাঠের পর নীরবে কবিকে প্রণাম জানাতে হয় এবং সমস্ত
সময়ের হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়-
১. পাগলের চটিজুতো মাথায় পরিয়ে দিয়ে
যারা আমায় নিয়ে চলেছে, তাদের কীভাবে
বোঝাই, আমিই বধ্যভূমি, আমিই শ্মশান।
- পৃষ্ঠা
২. তুমি কে, জলে অল্প ডুবে আছো, ভেসেই আছো বলা যায়
মুখের আদল স্পষ্ট নয়, হায় কেশরাশি, ভাগ্যাকাশ!
- ত্রয়োদশী
৩. অতিশয় নির্মম, জন্মান্ধ বৃষ্টির দেবতা এসে
আমার নাভিদেশ কোলে তুলে নিলেন, সেই থেকে
- আকাশপথে
৪. প্রশান্তি অন্ধকারে, প্রশান্তি আসন্ন আলোয়,
খর্বকায় আমার এ- মরদেহের শিয়রে
কে এসে দাঁড়ালেন? কে আপনি, দিন না রাত্রি?
- অমৃতসভা
আর বিশেষ কিছু বলার থাকে না অতঃপর, শুধু উল্লেখ করতে
হয় দুটি সংগোপন কবিতার। সমসাময়িকতার আগুনের ঢেউ থেকে উঠে এসে, সুস্নাত হয়ে এসে, যেখানে
এক অনুচ্চকিত গৌতম বলে উঠেছেন-
১. আমি শান্ত অগ্নিশিখা, ক্রোধে কম্পমান
- জন্মদিবস ১৪ মার্চ ২০০৭
২. বুকে গেঁথে দাও তমলুক, ছেঁড়া পতাকা।
- ভূমিস্পর্শমুদ্রা
বোঝা যায়,অব্যবহিত সত্যিই ভয়ংকর!
আমেন।
আখতারী বাঈ
.
.
শেষ বাক্যে পৌঁছবার আগেই আপনি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেন,
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।
শ্রাবণ
.
.
অন্ধকার কেঁপে-কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের
প্রহারে, নিমেষের জন্য তাঁর নতমুখের এক পাশ প্রকাশিত হয়, আবার ঘন তমসা। এক ভীষণ বিস্ফোরণের
অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত বয়ে যায়। মেঘের পাতায়-পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে
চলে আকাশের জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরও একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে? ক্ষয়ে-আসা,
ভেঙে-পড়া আয়ুর প্রান্তে তপ্ত পাথরফলকের মতো এই দাঁড়িয়ে-থাকা, অদৃশ্য নতমুখ তাঁর, ধুয়ে
যায়। ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে-ফাঁকে এতদিন পড়ে-থাকা দীর্ঘ বিরতিগুলি, নক্ষত্রগণনার
কাজ। অকস্মাৎ, আরও একবার আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙে পড়ে; দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হবার পর
তিনি স্পর্শ করেন আমায়, দেখি, নিচে, বহু নিচে, ওই রসাতল। সুয্যি দত্ত লেনের দাবার রোয়াক
থেকে আমি ডেকে উঠছি, ‘বিভুতিদা, বৃষ্টিআসছে!’ আঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসি ছুটে-ছুটে
ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে, রাজেনদের পায়রার ঝাঁক এক সাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজা
‘শ্রীরাধারক্রমবিকাশ’
.
.
জননীজঠরে শয়নের মতো পুরনো কথায়
ফিরে আসি
একদা আমি ভেবে বসেছিলাম প্রেমার্তি ও প্রদীপশিখায়
সম্পর্ক নেই কোনও, ভুলের ভীষণ রক্তে ভেসে-ভেসে এসেছি,
এইখানে এসে দেখি শ্রীরাধিকা পতঙ্গের রূপ ধরেছেন।
অন্ধকার, আপনি কি সম্মুখে এসে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত?
আপনার আচরণে কোপিত আমি, হতে পারি সামান্য জীব
হাড় আর পাঁজরা বের-করা আলোর প্রদেশের অধিবাসী,
তবু জানাই, আমি শ্রীরাধার নুন খাই, আর ঘুরে বেড়াই
রোদে-পোড়া, পক্ষীবিষ্ঠা ছড়ানো সন্ধ্যাকালের ঠাকুরদালানে,
এভাবেই, ভিক্ষাগ্রহণ, ইহজন্ম দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
সুমধুর বাতাস বইছে এখন, স্পষ্ট অনুভব করছি
ক্রোধানল স্তিমিত, চন্দ্রালোকের কথা ভাবতে ভালো লাগছে,
ইচ্ছে করছে, এই কল্পলোকে, কলঙ্কভোগের বিছানা পেতে
শিয়রের কাছে এক ঘটি শীতল জল রেখে, ঘুমিয়ে পড়ি।
একদা আমি ভেবে বসেছিলাম প্রেমার্তি ও প্রদীপশিখায়
সম্পর্ক নেই কোনও, ভুলের ভীষণ রক্তে ভেসে-ভেসে এসেছি,
এইখানে এসে দেখি শ্রীরাধিকা পতঙ্গের রূপ ধরেছেন।
অন্ধকার, আপনি কি সম্মুখে এসে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত?
আপনার আচরণে কোপিত আমি, হতে পারি সামান্য জীব
হাড় আর পাঁজরা বের-করা আলোর প্রদেশের অধিবাসী,
তবু জানাই, আমি শ্রীরাধার নুন খাই, আর ঘুরে বেড়াই
রোদে-পোড়া, পক্ষীবিষ্ঠা ছড়ানো সন্ধ্যাকালের ঠাকুরদালানে,
এভাবেই, ভিক্ষাগ্রহণ, ইহজন্ম দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
সুমধুর বাতাস বইছে এখন, স্পষ্ট অনুভব করছি
ক্রোধানল স্তিমিত, চন্দ্রালোকের কথা ভাবতে ভালো লাগছে,
ইচ্ছে করছে, এই কল্পলোকে, কলঙ্কভোগের বিছানা পেতে
শিয়রের কাছে এক ঘটি শীতল জল রেখে, ঘুমিয়ে পড়ি।
কবি গৌতম বসুর কাব্যগ্রন্থ 'অন্নপূর্ণা ও শুভকাল'
পাঠের পর:
রিমঝিম আহমেদ
"আমরা ভাবি, যে বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করলাম তার অতি অল্পই আমাদের চেতনাপ্রবাহে প্রবেশ
করতে দিয়েছি। একই সঙ্গে মনে-মনে বলি, হারায়নি কিছুই— এখনো দুটি আঁখির কোণে যায় যে দেখা/না-বলা
বাণী রয়েছে অধর ভরে।"
উপরোক্ত কথাগুলো কবি গৌতম বসুর। তার কথার সূত্র ধরেই বলি, এই
বিপুল আনন্দ-যাত্রায় কতটুকু পেরেছি সঙ্গ নিতে। এত ব্যর্থতার পাশ ঘেঁষে যে-টুকু সুর-সংযোজন
মননের দ্বারে এসে হাওয়া ছড়ালো কিঞ্চিৎ আমি ছুঁতে চেয়েছি মাত্র জংধরা জানালার কবাট খুলে।
কতটুকুই না আমি ধরতে পারি তার, অনেকটাই যে অধরা থেকে যাচ্ছে।
কবিতার এপারে আমি পাঠক, ওপারে কবি নিজে। আমাদের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে কবিতার
ভাষায়। কবি যা বলতে চেয়েছেন বা বলেছেন তা হুবহু ঠিক না ধরা গেলেও পাঠক মনে যে চাঞ্চল্যের
সৃষ্টি হয়েছে তার সারাংশটুকু লিখতেই পারি হয়তো।
তার আগে অন্নপূর্ণা ও শুভকাল কাব্যগ্রন্থ থেকে ৩নং কবিতাটি
পড়া যাক!
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল
∏
৩ ∏
.
একটি মানুষ ঘাসের জনতায়
রয়ে গেছে, যখন ফলকের সঙ্গে ফলকের সংঘাত
ধাতুর ক্রোধে বীর পড়েছে ভূতলে, রথ
টলতে-টলতে প্রবেশ করল যুদ্ধের আরও ভিতর;
সহস্র পদাতিক ঘাসফুল ঘিরে ধরেছে, শুঁড় দোলে
ঐরাবতের এই বুঝি শেষ হিংস্র দিন, ঘাসের
পায়ে অন্য ঘাসের মাথা, মাথা থেকে চিৎকার
নির্গত হলে হাওয়া ঘুরে ধুলো আঘাত করবে।
একসময় সূর্য আলো ফিরিয়ে নিলেন, মনে হলো
অবিমিশ্র হাহাকারের কাল, ঘাস থেকে মাঠ,
মাঠ থেকে বালকের দল, তাদের উল্লাসের
উপর দিয়ে হাহাকার বয়ে চলে, আকাশের বিরুদ্ধাচারী
রাশি-রাশি ছুটন্ত হাত, একটি ঘুড়ি আজকের ভোজন।
পংক্তিগুলোর পদরেখা ধরে ধরে হাঁটছি যেন ঘন কোন সবুজ গালিচায়।
"ঘাসের জনতা" শব্দযুগল নিমিষেই কল্পনায় এনে দেয় কোন বিস্তৃত সবুজ তৃণভূমিকে।
যেখানে অজস্র ঘাসফুল ফুটে আছে পায়ের কাছে। ঘাসের সাথে ঘাসের আলিঙ্গন। সূর্য আঁধারে
ঢলে পড়ার প্রাক্কালে ভেসে আসে মাঠে বালকদলের চিৎকার। আকাশের বিরুদ্ধে অজস্র ছুটন্ত
হাত। এবং তারপরই বুঝতে পারি একটি ঘুড়ির জন্য এই উল্লাস, হুড়োহুড়ি। যেটি হবে বালকের
আজকের ভোজন।
ভোজন? ঘুড়ি কি খাদ্যবস্তু? যা ভোজন করা যায়! এই ভাবনা পাঠক মানসে
করাঘাত করে
এবং তার ধ্বনি প্রসারিত হয়ে চলেছে পাঠকের ভাবনায় ... সে ভাবনার
প্রভা অনুভব করা যায়, সহ্য করা যায়, গন্তব্যে পৌঁছল কিনা তার ধার ধারল না।
বস্তুত কবিতার চিরপ্রভা আমাদের কতদূর নিয়ে যেতে পারে? তাঁর অন্তঃস্থ স্বরভঙ্গির অনন্য
বৈশিষ্ট্য এখানেই। আর তাই কবি গৌতম বসু আমার কাছে এক চিরবিস্ময়।
একই কাব্যগ্রন্থের ৭নং কবিতায় দেখি–
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল
∏
৭ ∏
আর নয়, অন্ধ-বিক্রেতার থেকে ধূপ কেনার সুযোগ নষ্ট হয়েছে
একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, অন্তরীক্ষ-পাশায় খাটে
তৃতীয়টি অধুনা যষ্টির পরচুলায়, দিন আনে, খায়,
মাঝির সংসার দুলে চলেছে।
নদীর চাহনির আশায় স্থলের মানুষ বলে
তাকাও, তাকাও, অন্তত কোনও ইঙ্গিত
আমরা অগ্নিপুত্র, ক্ষণিক—অবিকল এইভাবে
উড়োজাহাজের উদ্দেশে বন্যার্ত আবাদ থেকে হাহাকার উঠেছে।
শিকল দেখে আবার মনে পড়ল শব্দের কথা
শিকল রূপান্তরিত জল, সব দর্শক যখন অতীত
তখনও অনেক ভূমিকা থেকে যাবে
এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।
এই কবিতা প্রাণিত করে গেছে। কিছু বলে গেছে। কিছু বুঝিয়েছে কি
বুঝায়নি এর মীমাংসায় আসতে না আসতেই প্রাণিত করে গেছে। বোঝানোর দায় কি কবির আছে? নাকি
থাকতে আছে কখনো? অলঙ্ঘ্য বোধের বেড়া ডিঙিয়ে কেউ আজও সর্বসম্মতভাবে দাঁড়াতে পারেনি হয়তো
একই সংজ্ঞায়। বোধের আন্দোলন ঠেলে দেখি- আবছা আলোয় উঁকি দেয়া কোন ঘটনার বিচ্ছিন্ন পরম্পরা।
যেখানে, অন্ধ বিক্রেতার প্রতি মমতা, ধূপ কেনার সুযোগ হাতছাড়া হওয়া কিংবা দিনমজুর মাঝির
ভাসমান সংসার পানিতে দুলছে অবিরাম। যেখানে নদীর পানির জন্য মানুষের আকুতি আছে সেখানে
ফের দেখা যায় উড়োজাহাজের জন্য বন্যার্ত আবাদ থেকে হাহাকার উঠছে। শিকল দেখে শব্দের কথা
মনে পড়া কিংবা শিকল তৈরি জল, সে জলই প্রকৃত শ্মশানবন্ধু। প্রতিটি শব্দ-বাক্যের পারস্পরিক
সম্বন্ধপাতের ভেতর দিয়েই এ-কবিতার রসসিদ্ধি ঘটেছে। ধীরে ধীরে তাই চিৎমুকুরে দেখা যায় সমগ্রতার
প্রতিফলন। হতাশার আল ধরে বিশুদ্ধির দিকে অবিরাম যাত্রার মতো আনন্দপাঠের আরাম হয় পাঠকের
অন্তরে।
অনুভূতি ছেঁকে নিয়ে সে অনুভূতির অভিব্যঞ্জনার বিস্তার দেখি আমরা
এই কবিতায়। এখানে কবি ছড়িয়ে গেলেন অন্তর্জগতের অভিঘাতে অদ্ভূত হৃদয়াবেগ এবং সন্তত চেতনার
সঙ্গে তার পরিপুষ্টি। আর তা অবিচ্ছেদ্যভাবে মন থেকে মনান্তরে সঞ্চারিত করে। সঅময়সীমাকে
লঙ্ঘন করে চিরকালের বাণীতে পৌঁছে যায় কবির এই ভাষার বিস্তার।
১০ নং কবিতাটির দিকে চোখ মেলা যাক এবার।
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল
∏
১০ ∏
.
কিছু ভয় বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকত
ঝড়ের যন্ত্র যখন অবিরাম প্রসবিনী, কিছু ভয় অনাথ;
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যার উদ্দেশে কান পাতা রয়েছে
যার ভিতর, তমসা তাদের পথের কাঁটা, অহর্নিশ
জল বিতরণ করে, বৃক্ষের কুহক; আর এমন
নিদ্রার শোভা কেউ দেখেছে, কেউ দেখে নি
শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা।
পৃথিবীর আদিম বর্ষণ জল। হাওয়ার দৌরাত্ম্য এই প্রথম বেদনা ফিরে
ফিরে হৃদয়ে হানা দেয়। পরিণামে যদিও সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক সেই অভিজ্ঞতার আঘাতে শান্ত
হয়। আআত্যন্তিক শোচনীয়তা থেকে বেদনার সূচীমুখ তীব্রতায় প্রাতিস্বিক হয়ে ওঠে।
অন্ধকার ও বৃষ্টির রাতে মানুষের ভয় চিরাচরিত।
ঝড়ের রাতের অবিরাম প্রসবিত জল-প্রলাপ ভয়কে আরও অনাথ করে দেয়। অনাথ শব্দের সাথে বিপন্নতা
ও ভয়ের আত্মিক এক যোগাযোগ আছে। আছে আরও আশাহত ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের ইঙ্গিত। কবি এখানে
'অনাথ শব্দের যে কারিশমায় প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তা অনবদ্য।
'শব্দও একপ্রকার অন্ধকার'।
আরো কঠিন কোন মুহূর্তের ছবি যেন মনে করিয়ে দেয় আমাদের।
বিরামস্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে পরক্ষণেই মনে হয়- তারও তো আছে নিন্দ্রার
শোভা, যা কেউ অবলোকন করেছে, কেউ করতে পারেনি।
'শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে'...
এই শূন্যতা কি রিক্ততা? এমন উদাসীন রিক্ততা
থেকে সকল আলো কেউ যেন নষ্ট করে দিতে চায়। তখন আলোর মৃত্যু হয়ে অন্ধকারের জয় আসে পৃথিবীতে।
'অথবা
সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা' আরও কোন ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়।
চেতনে সঞ্চিত করে আরও বিপন্নতা। সে সংকট
আশাহীনভাবে বিপন্ন করে তোলে মানুষকে। প্রলয়তিমিরে ডুবিয়ে দেয়।
এখান থেকে
আরেকটি কবিতা পড়ি।
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল
∏
১৯ ∏
.
'রিক্সার উপরে যে তিন মদ্যপ রাত্রি ছিঁড়ে খেত
তারা ভালো হয়ে গেছে, বাকিদের শেষতম ট্রাম
এখনও বহন করে চলে, দোলায়, নাট্যকর্মী দোলে
পর্দার তার ও কলম বিক্রেতা, টিউশনশ্রমিক, আরও আছে
তুমি ভিয়েনের বামুন, তুমি ব্যর্থ প্রাবন্ধিক,
পিতা, কাদার শিশু ও গোলাপ চারা।
উন্মাদগতি এই ঘর, কুড়োয়, ছড়ায়, আর ক্রমাগত
দোলে, উচ্চাশার নড়বড়ে নৃত্য মানুষের মাথায়;
বাহির, অসম্পূর্ণ অন্ধকার, তুমি জানো, এদের দৃষ্টির
অনেকটাই অনুনয়, পুনর্বাসনের আশায় যারা পথে-পথে চরে।"
দৃশ্য এবং দ্রষ্টা, বদল ঘটে সবকিছুর। মাতাল ভালো হয়ে যায় কিন্তু
শেষতম ট্রামটা বাকিদের নিয়ে নিত্যকার মতোই টলমল করে, দোলায়। মঞ্চের ঝলমলে আলোয় যেন
গোটা জীবনটাকেই দোলে। বাহিরে,
অসম্পূর্ণ অন্ধকারে যাদের দৃষ্টিতে অনুনয়, তারা পুনর্বাসনের আশায় পথে পথে চরে। এই পথে
পথে চরা মানুষ আমাদের কাছে খুলে দেয় নিজস্ব অভিজ্ঞতার দুয়ার। আমরা স্বভাবতই লুব্ধ হই।
সময়-রূপ চতুর্থ আয়তনের মার্গে শাশ্বত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলতে না পারছে ততক্ষণ ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা নিতান্তই মূল্যহীন। কবিতাটিতে অতীত, বর্তমান ও আগামী এই তিনকালকেই লক্ষ করি।
অথবা ধরা যায় এই ত্রিকাল থেকে মুক্তির অভিপ্রায়-ই এই কবিতার আত্মিক দম্পদ।
এবার এই কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতাটি পড়ে দেখা যাক-
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল
∏
২২ ∏
.
এমন হলো তাদের পাপ দ্বারে-দ্বারে ফেরে
যেখানে যায় অশ্রুর লোহা প’ড়ে আছে, অন্যের অশ্রু
মানুষ স্তব্ধতার ব্যবহার জানে।
আবার ভাতের থালা তুলে ধরো, এই বর্ম
স্বহস্তে খোলার জন্য নয়, যখন সময় হবে
সকলেরই হয়, সেদিন ওই দায় ভাগ্যহীন সন্তানের।
যে জানে শেষাংশ কিভাবে গীত হবে, সেই জন সমাপ্তির রাজা
সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা, আমি মূঢ়
আমার সঙ্গে বলো, অন্নপূর্ণা ও শুভকাল।
এই কবিতাটির দেহে ভাবানুষঙ্গের ধ্বনি-সাদৃশ্য রচনার কৌশল বিশেষভাবে
লক্ষ করবার মতো। কবিতা পড়বার শুরুতে যা যা শুধুমাত্র বুদ্ধিগ্রাহ্য ভাবনা ছিলো তা শেষাবধি
অনুভূতিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়।
'এমন হলো তাদের পাপ দ্বারে-দ্বারে ফেরে'-
হয়তো কারো পাপ আজ দ্বারে-দ্বারে ফিরছে। যেখানে যাচ্ছে, অশ্রুর লোহা পড়ে আছে এবং তা
অন্যের অশ্রু। বলছেন- ' মানুষ স্তব্ধতার ব্যবহার জানে।' এই পংক্তি দিয়ে মানুষের চিন্তা, অসহায়তা,
একাধিক পরিস্থিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবতার সাথে নিবিড়তারও সূত্রপাত ঘটেছে। এই
পংক্তিটির এখানে অমূল্য অথচ নির্মোহ ব্যবহার কবিতাটিকে মহত্ব দান করে গুহা আঁধারে রচিত
চিত্রকলায়, গুহা মানে এখানে হৃদয়কেই ইঙ্গিত করেছি।
'আবার ভাতের থালা তুলে ধরো, এই বর্ম
স্বহস্তে খোলার জন্য নয়, যখন সময় হবে
সকলেরই হয়, সেদিন ওই দায় ভাগ্যহীন সন্তানের।'
প্রতীক্ষার শাশ্বত আবেগই ধ্বনিত হয় এখানে। নিরলস প্রতিকূল সময়
কেটে গিয়ে অনুকূল সময়ের প্রতীক্ষা। নির্নিমেষ জাগর অবস্থায় ভাগ্যহীনতার দায়, জীবনের
বিশাল দ্বন্দ্বময়তার স্মারক। এসবের কুণ্ঠিত আভাস পাওয়া যায় মাত্র, আর বাকিটা স্পর্শের
অতীত।
'যে জানে শেষাংশ কিভাবে গীত হবে, সেই জন সমাপ্তির রাজা
সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা, আমি মূঢ়
আমার সঙ্গে বলো, অন্নপূর্ণা ও শুভকাল।'
প্রকৃত অর্থেই যে জানে, শেষটা কেমন গাইতে হবে, সে-ই মূলত সমাপ্তির
রাজা। সোজা কথায়-"শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।" বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই তা
জানে এবং প্রয়োগ
করে। এই বিদ্যা বিদ্যা মূলত চতুরস্বভাবীদের। কবি এখানে তাই মূঢ়। এটি কি কবির মর্মবেদনা
নয়? যখনই এই অবশ্যাম্ভাবী বেদনার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, তখনই তা হানা দেয় আঘাতে যে-কোন
চৈতন্যবান, মননশীল মানুষের অন্তরাত্মায়। তবুও কবি অন্তরের স্বধর্ম হিসেবেই প্রতিভাত
করতে চান- "অন্নপূর্ণা ও শুভকাল।"
বিশ্রামতলা
.
.
তার কাছে বৃষ্টির মতো ফিরে আসি
আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে
বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;
নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি,
চন্দ্রকিরণতলে যেদিকে চাই, দেখি,
আলোর কলস চূর্ণ, শঙ্খধ্বনির ভিতর
এই পথ, মাঠ, কৃষ্ণকায় বৃক্ষগুলি জেগে আছে।
সে কোথায়, কোথায় তার সুরমাখা কঙ্কণ, শূন্যতা ছুঁয়ে আছি
এ-শূন্যতায় বুকের আলো বুকে নিভে যায়।
আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে
বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;
নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি,
চন্দ্রকিরণতলে যেদিকে চাই, দেখি,
আলোর কলস চূর্ণ, শঙ্খধ্বনির ভিতর
এই পথ, মাঠ, কৃষ্ণকায় বৃক্ষগুলি জেগে আছে।
সে কোথায়, কোথায় তার সুরমাখা কঙ্কণ, শূন্যতা ছুঁয়ে আছি
এ-শূন্যতায় বুকের আলো বুকে নিভে যায়।
গল্প
.
.
অসুরদের উপদ্রবে স্বর্গলোক যখন বিপন্ন,
সেই সুদূর অতীতকালে দেবতারা অনেকেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। স্বর্গের রাত্রি কেমন আমরা
জানি না, কল্পনা করি, অন্ধকারই হবে। কোনও এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রাতে, অতিসাধারণ বেশে দেবী
নৌকায় উঠে বসলেন সবার অগোচরে, সঙ্গে দু’তিনজন বিশ্বস্ত ভৃত্য। সাতরাত সাতদিন অবিরাম
নৌকাচালনার পর মাঝিরা নির্বল, এক সাঁঝের বেলায় নৌকার গলুই এসে ঠেকল এই পোড়া বাংলাদেশের
শীর্ণ এক নদীর পাড়ে।
রাজরাজেশ্বরী রয়ে গেলেন এই গ্রামে।
পৃথিবীর শাড়ি, পৃথিবীর গয়নায় নতুন ক’রে সাজানো হলো তাঁকে, মন্দির স্থাপিত হলো। গ্রীষ্মের
দুপুরে সেই মন্দিরের ঠাকুরদালানে ব’সে কেউ-কেউ ইষ্টনাম জপতেন, মাথায় হাত রেখে শীতল
মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তেন কেউ-কেউ, দু’একটা কুকুর মন্দিরপ্রাঙ্গণে নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করত।
দেবী কথা বলতেন না, তাই স্বর্গে তাঁর ঐশ্বর্যের কথা গ্রামবাসীগণ জানতে পারেন নি, তবু
তাঁরা সাধ্যমতো রাজরাজেশ্বরীর সেবা করতেন। যে-বছর ফসল ভালো হতো, সেই বছরে নতুন গয়না
গড়িয়ে দিতেন কোনও সম্পন্ন গৃহস্থ, দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিয়ে দেবী একবার পেয়ে গেলেন
শিকল পরানো, ধাতুর পাতে মোড়া, লাল অক্ষরে ভক্তের নাম লেখা, প্রণামীর নতুন বাক্স। খুব
জাঁকজমকের সঙ্গে সন্ধ্যারতি সারা হতো, ধূপধুনো চামরের পিছনে দেবীর নিশ্চল, প্রসন্ন
মূর্তির দিকে চেয়ে-চেয়ে ঘোর লেগে যেত, মনে হতো সত্যই স্বর্গীয় ভাবের অধিকারিণী দেবী
রাজরাজেশ্বরী। কখনও কি স্বর্গে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগত তাঁর? দেবী কথা বলতেন না।
কালের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে ভাগ্যও
রূপান্তরিত হয়; নদীর কোল ঘেঁষা অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্যজীবনে এক দুঃসময় অতর্কিতে
এসে আছড়ে পড়ল। অকারণে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ঘরদুয়ার, কাছারি ও ধানের গোলা; বহুপূর্বে
দেবী যেমন স্বর্গরাজ্য পিছনে ফেলে এসেছিলেন, প্রায় তেমনভাবেই রাতের অন্ধকারে, নৌকায়,
গরুর গাড়িতে, ছেলে কাঁধে ও ঘটিবাটি মাথায় নিয়ে, পায়ে হেঁটে, মানুষ পালাতে লাগল।
রাজরাজেশ্বরী ত্যাগ করতে পারলেন
না সেই পুড়ে-যাওয়া গ্রাম, প্রবাসের বিষণ্ন মৃত্তিকা।
গৌতম বসু, অসম্ভবের প্রতিমা আর একটি প্রলাপ
অনিতেশ
চক্রবর্তী
১
এই লেখা যখন
লিখছি, তখন জ্বর এসে বসেছে পাশে। আর ক্রমাগত আমায় জলের দিকে নিয়ে চলেছেন গৌতম বসু।
যতবার পড়ি, ততবার তাঁকে বড়ো বিপজ্জনক কবি মনে হয়। তিনি অনায়াসে পাঠককে টেনে আনেন
জলে বা শিকলে। লিখতে পারেন, “শিকল দেখে আবার মনে পড়ল শব্দের কথা / শিকল রূপান্তরিত জল, সব দর্শক যখন অতীত / তখনও অনেক ভূমিকা থেকে যাবে / এই জল
প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল
রামপ্রসাদ সেন।” কবিতায় বন্যার অনুষঙ্গ পাক খেয়ে উঠেও সহসা ডুব দেবে রামপ্রসাদীতে।
গৌতম বসুও এভাবে বারবার নিজের হাতে গড়া প্রতিমা থেকে পরক্ষণে সরে আসবেন ভিন্ন
প্রতিমায়। যাঁর কবিতার শেষে ওঁত পেতে বসে থাকবে অসম্ভব। যাঁর প্রতিটা শব্দ,
বিভক্তি-হীনতা নিয়ে শব্দের শব্দের পর শব্দ লেখা যায়। এবং কবিতার যে-কোনো বিশ্লেষণই
আসলে কবিতাকে ক্ষতি করে। কবিতার অন্তর্লীন মগ্নতাকে, আড়ালকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে
নিয়ে আসে। কবিতার মাতৃগর্ভের বাইরে শব্দেরা মাতৃঘাতী।
এই লেখাও, অতএব, কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধার-পাশ ঘেঁষবে না। কবিতার
বিশ্লেষণ কীভাবে করা উচিত, তা ভালো বুঝিও না অবশ্য। গৌতম বসুর কবিতার কাছে আশ্রয়
পাওয়ার কিছু ছেঁড়া-ছেঁড়া উপলব্ধি এই লেখায় থাকবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কালক্রম ভেঙে যাবে
নিশ্চিত। ১৯৮১-তে প্রকাশিত ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ আর ২০১৩
সালের বই ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’-র কবিতারা তাই মিলেমিশে যাবে। যদি কেউ এই লেখার ভিতর
দিয়ে কবি গৌতম বসুকে আদ্যোপান্ত চিনতে চান, তিনি প্রতারিত হবেনই। আগেভাগেই বলে
রাখা ভালো।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি।
উমার ফেরার পথ জলমগ্ন। আর গৌতম বসু তাঁর কবিতার পথে বিছিয়ে রেখেছেন বৃষ্টিকেই। আর জল। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর
পথে’-র ‘বিশ্রামতলা’ কবিতায় যেমন বৃষ্টির মতোই নশ্বর সেই ফিরে আসা। অথচ, যার কাছে
ফেরা সে কই?
‘তার কাছে বৃষ্টির মতো ফিরে আসি
আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে
বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;
নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি,
চন্দ্রকিরণতলে যেদিকে চাই, দেখি,
আলোর কলস চূর্ণ, শঙ্খধ্বনির ভিতর
এই পথ, মাঠ, কৃষ্ণকায় বৃক্ষগুলি জেগে আছে।
সে কোথায়, কোথায় তার সুরমাখা কঙ্কণ, শূন্যতা ছুঁয়ে আছি
এ-শূন্যতায় বুকের আলো বুকে নিভে যায়।’
আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে
বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;
নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি,
চন্দ্রকিরণতলে যেদিকে চাই, দেখি,
আলোর কলস চূর্ণ, শঙ্খধ্বনির ভিতর
এই পথ, মাঠ, কৃষ্ণকায় বৃক্ষগুলি জেগে আছে।
সে কোথায়, কোথায় তার সুরমাখা কঙ্কণ, শূন্যতা ছুঁয়ে আছি
এ-শূন্যতায় বুকের আলো বুকে নিভে যায়।’
‘আমার দুইকূল তার চোখের কালি,
জলভারে/বেঁকে নীল হয়,’—এমনভাবে হয়তো লিখতে পারেন একমাত্র গৌতম
বসুই। প্রকৃতপক্ষেই যে-কোনো কবির লেখা আসলে শুধু তাঁরই সন্তান। সেই স্বরের কোনো
ভাগিদার নেই। গৌতম বসুরও সিগনেচার ভাষা আছে, শব্দ আছে, শব্দহীনতাও আছে। এই কবিতায়
যেমন বৃষ্টি আদতে নেই। কিন্তু কবিতার শুরু বৃষ্টিতে। না-থাকা বৃষ্টির মতো সেই ফিরে আসার পথ ধরে
হাঁটতে হাঁটতে পাঠক দেখেন চারপাশে আলো। চরাচর জুড়ে যেন থইথই করে আলোকিত শূন্যতা।
শূন্যতায় বুকের আলো বুকেই নিভে যায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’-এর
১০ সংখ্যক কবিতায় এই গৌতমই লিখেছিলেন ‘শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে’। সেই কবিতার শুরুতেও বৃষ্টি। সে এক ভয়ঙ্কর
কবিতা...
‘কিছু ভয় বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকত
ঝড়ের যন্ত্র যখন অবিরাম প্রসবিনী, কিছু ভয় অনাথ;
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যার উদ্দেশে কান পাতা রয়েছে
যার ভিতর, তমসা তাদের পথের কাঁটা, অহর্নিশ
জল বিতরণ করে, বৃক্ষের কুহক; আর এমন
নিদ্রার শোভা কেউ দেখেছে, কেউ দেখে নি
শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা।’
ঝড়ের যন্ত্র যখন অবিরাম প্রসবিনী, কিছু ভয় অনাথ;
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যার উদ্দেশে কান পাতা রয়েছে
যার ভিতর, তমসা তাদের পথের কাঁটা, অহর্নিশ
জল বিতরণ করে, বৃক্ষের কুহক; আর এমন
নিদ্রার শোভা কেউ দেখেছে, কেউ দেখে নি
শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা।’
শব্দ একপ্রকার অন্ধকার। সেই অন্ধকারে
পাঠককেও কান পাততে হয় বৈকি। সে আবিষ্কার করে নিদ্রার শোভা সত্যিই দেখা হয়নি তার। ভয় থেকে কবি কখন যেন সরে
আসেন রহস্যে। আর কবিতা শেষ হয় বড়ো বিপজ্জনক এক বাঁকে, হত্যাদৃশ্যের প্রতিমায়। পাঠক আছাড় খেয়ে পড়ে অতল অন্ধকারে। কবিতার শেষে এমন
অপ্রত্যাশিতকে বুনে দেওয়ার সহজাত একটা ম্যাজিক জানা আছে গৌতম বসুর। এই ম্যাজিকও তাঁর নিজস্ব, কেবলই তাঁর।
২
‘জলের চেয়েও ক্লান্ত তার দেহের ’পরে ভোরের আলো এসে পড়েছে। জল তার দেহের
চেয়েও ক্লান্ত, তাকে বহন করে, বহন করে
সহস্র কণায় চূর্ণ হয়ে-যাওয়া সূর্যালোক; জল নিজেকে বহন করে।
ঘুম ফুরিয়ে গেছে বেহুলার, ঘুম তবু শুয়ে রয়েছে তার কোলে,
ঘুমের দুয়ারে আলো এসে পড়েছে।
নদীর পাড়ে যে জীবন সে ফেলে এসেছে, তাকেও স্পর্শ করো রশ্মিসকল, সমস্তই অস্পষ্ট এই ভোরে; ঘাটের সিঁড়িগুলি একে-একে
উঠে গেছে কুয়াশার দিকে, সিঁড়ির ফাটলে হাওয়ায় কাঁপছে একটি
চারাগাছ, সমস্তই স্বর্গের মতো নীরব। দুঃখিনী আমাদের এই মেয়ে
আর কোনওদিন এসে দাঁড়াবে না পেয়ারাতলায়, হাঁটবে না ভিজে ঘাসে,
যেখানে পাড়-ভাঙার শব্দ ডুবে যায় নদীতে, সেই
কুয়াশায় গচ্ছিত রইল তার এই পৃথিবী।
সম্মুখে দেখা যায় সমুদ্রের মতো নদী, আকাশের মতো সমুদ্র, ব্রহ্মাণ্ডের
মতো আকাশ।’
এমন কবিতার সামনে চুপ করে যেতে সাধ হয়। অথচ কথা হতে হয়, কথা হচ্ছিলও। শব্দের পর শব্দের অন্ধকার। হচ্ছিল জল আর বৃষ্টির কথা। কখনো বা নদীর কথাও। গৌতম বসুর কবিতায়
বারবার বিছিয়ে থাকে এই জল। সেখানে কোথাও নদী বইছে, সঙ্গে বয়ে চলেছে বেহুলার ভেলা ও
কবিতা। নদীর বক্ষদেশেই জন্ম নিচ্ছে গল্প, প্রতিমার নিরঞ্জনও সেখানে। জএল ভাসতে
ভাসতেই পাঠক এসে দাঁড়ায় অনন্তের সামনে। নদী যে ব্রহ্মাণ্ডই, তা চিনিয়ে দেন গৌতম।
‘ঘুম ফুরিয়ে গেছে বেহুলার, ঘুম তবু শুয়ে রয়েছে তার কোলে, ঘুমের দুয়ারে আলো এসে
পড়েছে।’—আহা, এমন পঙ্ক্তির কাছে নজানু হতে ইচ্ছে করে একজন্ম। জীবনানন্দের কবিতায়
বেহুলা ‘কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্নাকে নদীর চড়ায়
মরে যেতে দেখেছিল। আর গৌতম বসুর কবিতায় নদীর বুকে চড়া নেই। বরং সেই নদী জুড়ে বড়ো
বেশি জল, আদিগন্ত। সেখানে ভাগশেষে ‘সমুদ্রের
মতো নদী, আকাশের মতো সমুদ্র, ব্রহ্মাণ্ডের মতো
আকাশ।’ বেহুলা নিজেই যেন নদী। তার বয়ে চলার শেষ কই? অমরার হদিশ এই কবিতায় নেই। বেহুলার
কোলে চিরঘুমে তারই জীবন। আর আছে নদীর পাড়ে বিগত সব। গৌতম যখন লেখেন, ‘নদীর পাড়ে যে
জীবন সে ফেলে এসেছে, তাকেও স্পর্শ করো রশ্মিসকল’, তখন ধীরে ধীরে আলো পড়ে সেইসব
দৃশ্যে। কবিতা এতখানি দর্শনীয়ও হয়ে উঠতে পারে! সেই বিগত, অস্পষ্ট কুয়াশার মতো ফেলে
আসা সব, ঝাপসা আর সামনে অনন্তের মতো ব্রহ্মাণ্ডের মতো নদী। এই নদী পার করে কেই বা
পৌঁছবে অমরায়! বেহুলা, বেহুলারা? নাকি মঙ্গলকাব্যের চিরাচরিত অন্ত্যমিল। নদী জানে,
তার বক্ষদেশই বেহুলাদের শেষ ক্লান্তির ঠাঁই, শেষ ঘুম।
এই বৃষ্টির ঘেরাটোপে বসে ফের পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, ‘রসাতল’ এক আশ্চর্য বই।
ঠাসবুনোটের মতো টানা সজ্জায় কবিতারা কখন সরে এসেছে গল্পের দিকে। শেষে অপেক্ষা করে
আছে অসম্ভব। গৌতম বসুর বহু কবিতারই যা বৈশিষ্ট্য। ‘গল্প’ কবিতায় কবিতা আর গল্পের
মাঝের ভূখণ্ড ঝাপসা। যেমনই ঝাপসা দৈব আর মানবের ইতিহাস। সবই কেমন অলীক মিলিয়ে দেন
গৌতম বসু।
‘অসুরদের উপদ্রবে স্বর্গলোক যখন বিপন্ন, সেই সুদূর অতীতকালে দেবতারা অনেকেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। স্বর্গের রাত্রি
কেমন আমরা জানি না, কল্পনা করি, অন্ধকারই হবে। কোনও এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রাতে, অতিসাধারণ
বেশে দেবী নৌকায় উঠে বসলেন সবার অগোচরে, সঙ্গে দু’তিনজন বিশ্বস্ত ভৃত্য। সাতরাত সাতদিন অবিরাম নৌকাচালনার পর মাঝিরা নির্বল, এক সাঁঝের বেলায় নৌকার গলুই এসে ঠেকল এই পোড়া বাংলাদেশের শীর্ণ এক নদীর পাড়ে।’
‘স্বর্গের রাত্রি কেমন আমরা জানি না, কল্পনা
করি, অন্ধকারই
হবে।’ একটি মোহর থেকে পরের মোহর। কিন্তু, এ কোন দেবীর গল্প বুনছেন গৌতম? কোন ইতিহাস আর দৈব
একাকার হয়ে যায় শেষে? স্বর্গ ছেড়ে নেমে আসা দেবী রাজরাজেশ্বরী মর্ত্যের শিকড় ছেড়ে
পালাতে পারেন না। কিন্তু, পোড়া বাংলাদেশের শীর্ণ
এক নদীর পাড়ে বাসা বাঁধা সেইসব মানুষদের শিকড়টাই যে কেটে যায়। তারা আজ থেকে ছিন্নমূল।
ছিন্নমূল মানুষের ছিন্নমূল দেবী। এক শিকড় গাঁথা হয়, অন্য শিকড় যায় উপড়ে। অথবা, সেই
দেবীর গল্পটা আসলে এমনই। গল্প অথবা ইতিহাস...
‘বহুপূর্বে
দেবী যেমন স্বর্গরাজ্য পিছনে ফেলে এসেছিলেন, প্রায় তেমনভাবেই রাতের অন্ধকারে, নৌকায়, গরুর গাড়িতে, ছেলে কাঁধে ও ঘটিবাটি মাথায় নিয়ে, পায়ে হেঁটে, মানুষ পালাতে লাগল।
রাজরাজেশ্বরী
ত্যাগ করতে পারলেন না সেই পুড়ে-যাওয়া গ্রাম, প্রবাসের বিষণ্ন মৃত্তিকা।’
এই কবিতাতেও নদী। যে নদী স্বর্গ থেকে বয়ে এসে মেশে বাংলাদেশের শীর্ণ আরেক নদীতে। কবি সেই জলপথ
চেনেন, তাই এই দেবীর গল্পও তাঁর জানা। নদীপথ ছাড়া এই কবিতার দেবী কীভাবেই বা নেমে
আসতেন স্বর্গ ছেড়ে মাটিতে! নদী ছাড়া আছে বৃষ্টি। অন্যত্র। ‘শ্রাবণ’ কবিতাটি গৌতম
বসুর অন্যতম আলোচিত কবিতা। কবিতার আদ্যন্ত জুড়ে বিস্ফোরণ বা বজ্রপাতের অপেক্ষা,
রসাতল, স্মৃতি আর ম্যাজিক।
‘অন্ধকার কেঁপে-কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের প্রহারে, নিমেষের জন্য
তাঁর নতমুখের এক পাশ প্রকাশিত হয়, আবার ঘন তমসা। এক ভীষণ বিস্ফোরণের
অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত বয়ে যায়। মেঘের পাতায়-পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে চলে আকাশের জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরও একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে? ক্ষয়ে-আসা, ভেঙে-পড়া আয়ুর প্রান্তে তপ্ত পাথরফলকের
মতো এই দাঁড়িয়ে-থাকা, অদৃশ্য নতমুখ তাঁর, ধুয়ে যায়। ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে-ফাঁকে এতদিন পড়ে-থাকা দীর্ঘ বিরতিগুলি,
নক্ষত্রগণনার কাজ। অকস্মাৎ, আরও একবার
আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙে পড়ে; দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ
করেন আমায়,
দেখি, নিচে, বহু নিচে, ওই রসাতল। সুয্যি দত্ত লেনের দাবার রোয়াক
থেকে আমি ডেকে উঠছি, ‘বিভূতিদা, বৃষ্টিআসছে!’ আঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসি ছুটে-ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে,
রাজেনদের পায়রার ঝাঁক এক সাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজানা
পৃথিবীর দিকে।’
বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কবিতার একটি অদ্ভুত ব্যাখ্যা
দিয়েছিলেন গৌতম। বলা ভালো ভৌতিক ব্যাখ্যা-- “ওপর থেকে ভূত হয়ে
গিয়ে সে যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে। মরে ভূত হ’য়ে গেছে…নিচে বহু বহু দুরে তার পরিচিত পৃথিবীর দৃশ্য দেখে সমস্তই কেমন অচেনা মনে
হচ্ছে। আমি ভূত হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু আমার পাশে আরেক জন আছেন, যিনি ভূত নন, কিন্তু তার বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু বলতে
পারব না।” কবিদের দেওয়া ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকভাবেই বেশ বিপজ্জনক। তাছাড়া, কবিতার পাঠে কবির অধিকার নেই। অতএব, আমরাও
বিস্মিত হতে পারি নির্বিঘ্নে এক বজ্রপাত থেকে আরেক বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে যেতে
কবিতায় রসাতল থেকে উপচে ওঠা স্মৃতিতে। দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত না হলে সেই স্মৃতির কাছে
ফেরা যায় না। সেখানে বিভূতিদা, টুকুমাসি আর রাজেনদার পায়রার ঝাঁক। আরো নিচে অজানা
পৃথিবী। নক্ষত্রগণনার কাজ ধুয়ে যায়...
এই টুকুমাসির কথাই ফিরে আসে গৌতম বসুর
‘জরাবর্গ’-র শেষ কবিতায়। ‘এবারের মতো তোমার আঁচল খালি করো, টুকুমাসী,
/ সমস্ত সংগ্রহ তোমার, নামিয়ে, গড়িয়ে দাও ভুঁইয়ে। / আমরা আজও কয়লার পাহাড়ের দেখা পেলাম না।।’
টুকুমাসির আঁচল খালি হলে সব সংগ্রহ নেমে আসবে ভুঁইয়ে। সেই আঁচল পাতা হবে
কতখানি জুড়ে? অনন্ত, চরাচর ছুঁয়ে রসাতলে? সংগ্রহ বিছিয়ে থাকবে কতখানি? কবিতাকে
অবশ্য প্রশ্ন করা চলে না। এই বইয়ের শুরুতেই গৌতম লিখেছেন, ‘সব প্রশ্ন থেকে ভীষণ
প্রতিহত, ফিরে আসছিলাম / আমার গায়ে, প্রহরী,
সেই ছায়া এসে পড়ল আবার, / যেন-বা কাঁধের এক
পাশ মেঘের গর্জনে ভিজে গেছে।।’ আমরা শুনি মেঘের গর্জনেও কাঁধের একপাশ ভিজে যায়।
আমরাও খুঁজি কয়লার পাহাড়। আর শ্রাবণ পেরিয়েও বৃষ্টি থামে না।
৩
ছোটোবয়সে যখন তিরিশের কবি, চল্লিশের কবি,
সত্তরের কবিদের কথা শুনতাম, তখন সময়ের এই হিসেব শুনে অবাক লাগত। যে মানুষটা
তিরিশের দশকে লেখা শুরু করে ষাটের দশক অবধি লিখলেন, তিনি কেন শুধুই তিরিশের কবি?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো তিনিও বইছেন। নিজেকে ভাঙছেনও অনেকে। বদলাচ্ছেন। গৌতমও যেমন
বদলেছেন কবিতাকে। কিন্তু আজ বুঝি, কবির গায়ে একটা অদৃশ্য সময় লেপ্টে থাকেই। সেই
সময়ের কালি দিয়েই কবিরা লেখেন। সেই সময় আর কিছুতেই ফিরতে পারে না পরে। গৌতম বসুর
কবিতা পড়তে পড়তেও মনে হয়, অনেককিছু চলে গেছে, নেই আর। সময়ের হিসেবে তিনি আশির কবি।
কিংবা বড়োজোর বলা চলে শেষ সত্তরের। তাঁর নিজের একটি সময় আছে। সময়ে গাঁথা স্বর,
প্রতিমা, অনুভব... সেই সময়টা, ঘোর, তার বাস্তুতন্ত্র ও বিশ্বাস—আর নেই। ফিরবে না।
থাকার মধ্যে সেতুসম্ভব হয়ে রয়েছে এইসব কবিতা।
‘এবাজুদ্দিন লস্কর’-কে এমনই এক পিছুফেরা সময় থেকেই আবিষ্কার করেন কবি। দূর
থেকে দেখান, ‘এবাজুদ্দিনের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়;
উঠোনে ধান বিছানো নেই, রেডিও
বাজছে না, দাওয়ায় একটা ছেঁড়া গামছা মেলা আছে।’ এইসব ‘নেতির’ কার্যকারণ স্পষ্ট হয় পরের
স্তবকে। এবাজুদ্দিন দেখতে পান না চোখে। কবিও কি পান? কিংবা পাঠক! ‘বিপুল হাওয়ায় চুলদাড়ি উড়ছে, মাথা উঁচু; গোধূলিবেলায় সেই নিশ্চল মূর্তির সম্মুখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে
থেকেছি, এক আলোকময় সিংহদ্বারের দুই জন্মান্ধ প্রহরী।’ এবাজুদ্দিন যে-অর্থে জন্মান্ধ,
কবি সেই অর্থে নন। অথচ, কবির জন্মান্ধতার তলই বা কীভাবে পাবেন এবাজুদ্দিন!
তল আর মেলে কই?
ঘোরের ওপর ঘোরের স্তূপ জমা হয়। উদ্ধৃতির ভিড় দীর্ঘতর হবে এই লেখায়। হতে বাধ্য,
উপায় নেই। আমাদের ঐশ্বরিক এক মগ্নতার দিকে যেন টেনে নিয়ে যান গৌতম বসু। ‘সৈকত’
কবিতার শেষে উপুড় হয়ে পড়ে হয়রৎ।
‘একটি সবুজ
পাতার মুখে শোনা গোপন কথাগুলি
হারিয়েছি, বিপদকালে হারিয়ে ফেলে, সূর্যাস্তের ন্যায়
কেঁদেছি, ডুবেছি, আসমুদ্র ছড়িয়ে পড়েছি, যবনিকা।
আরও দূরে মিশে যায় শেষতম মশালের আর্তনাদ,
নিজের পদচিহ্নদের নিয়ে ধুলোয় ফিরে যেতে চাই,
চাই কুশাসন, ওই ছায়াপথ ভেঙে পড়েছে মাথায়।
চোখের মণি অবধি উঠে-আসা পাপ, ডাকে, আমি শুনি
রসুল, রসুল।’
হারিয়েছি, বিপদকালে হারিয়ে ফেলে, সূর্যাস্তের ন্যায়
কেঁদেছি, ডুবেছি, আসমুদ্র ছড়িয়ে পড়েছি, যবনিকা।
আরও দূরে মিশে যায় শেষতম মশালের আর্তনাদ,
নিজের পদচিহ্নদের নিয়ে ধুলোয় ফিরে যেতে চাই,
চাই কুশাসন, ওই ছায়াপথ ভেঙে পড়েছে মাথায়।
চোখের মণি অবধি উঠে-আসা পাপ, ডাকে, আমি শুনি
রসুল, রসুল।’
রসাতলের পর
নয়নপথগামী, স্বর্ণগরুড়চূড়া--- কবিতার এই পর্বে গৌতম সরে এসেছেন ভিন্ন গভীরতায়।
সেখানে বিসমিল্লার সুরকে সঙ্গত করে বৈষ্ণব অনুষঙ্গ। অন্তর্ঘাতের মতো বাসা বাঁধে
কিছু সর্বনেশে পঙ্ক্তি—
‘অখণ্ড একটি
শোকদিবসের কিনারায়
গলায় শ্রীখোল প’রে দাঁড়িয়েছিলাম ব’লে
কেউ-কেউ তীব্র হেসে উঠেছিল, আমি জানি।
আমি জানি, ধুলোর মতন প’ড়ে থাকা যায়
কিন্তু ধুলো হয়ে-ওঠা ততটা সহজ নয়।
গলায় শ্রীখোল প’রে দাঁড়িয়েছিলাম ব’লে
কেউ-কেউ তীব্র হেসে উঠেছিল, আমি জানি।
আমি জানি, ধুলোর মতন প’ড়ে থাকা যায়
কিন্তু ধুলো হয়ে-ওঠা ততটা সহজ নয়।
নীরব
দৈত্যকুলের হে অবশেষ, প্রণাম!’
(বইয়ের ধুলো
ঝাড়ার সময়ে লেখা)
‘শ্রীরাধারক্রমবিকাশ’
কবিতাটির শুরুতেই এক অবিশ্বাস্য স্মৃতি। ‘জননীজঠরে শয়নের মতো পুরনো কথায়’ ফেরা যে
যায় না বলেই ‘একদা’ এক ভেবে বসার গপ্প ফাঁদেন কবি। ক্রমবিকাশের স্তর ওলটপালট খেতে
শুরু করে? শ্রীরাধা পতঙ্গের রূপ ধরে কোন আগুনের কাছে আসেন? আর, সেসবের পাশেই গৌতম
সাজিয়ে দেন এক ভিন্ন ক্রমবিকাশের আখ্যান।
‘আপনার আচরণে কোপিত আমি,
হতে পারি সামান্য জীব
হাড় আর পাঁজরা বের-করা আলোর প্রদেশের অধিবাসী,
তবু জানাই, আমি শ্রীরাধার নুন খাই, আর ঘুরে বেড়াই
রোদে-পোড়া, পক্ষীবিষ্ঠা ছড়ানো সন্ধ্যাকালের ঠাকুরদালানে,
এভাবেই, ভিক্ষাগ্রহণ, ইহজন্ম দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
সুমধুর বাতাস বইছে এখন, স্পষ্ট অনুভব করছি
ক্রোধানল স্তিমিত, চন্দ্রালোকের কথা ভাবতে ভালো লাগছে,
ইচ্ছে করছে, এই কল্পলোকে, কলঙ্কভোগের বিছানা পেতে
শিয়রের কাছে এক ঘটি শীতল জল রেখে, ঘুমিয়ে পড়ি।’
হাড় আর পাঁজরা বের-করা আলোর প্রদেশের অধিবাসী,
তবু জানাই, আমি শ্রীরাধার নুন খাই, আর ঘুরে বেড়াই
রোদে-পোড়া, পক্ষীবিষ্ঠা ছড়ানো সন্ধ্যাকালের ঠাকুরদালানে,
এভাবেই, ভিক্ষাগ্রহণ, ইহজন্ম দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
সুমধুর বাতাস বইছে এখন, স্পষ্ট অনুভব করছি
ক্রোধানল স্তিমিত, চন্দ্রালোকের কথা ভাবতে ভালো লাগছে,
ইচ্ছে করছে, এই কল্পলোকে, কলঙ্কভোগের বিছানা পেতে
শিয়রের কাছে এক ঘটি শীতল জল রেখে, ঘুমিয়ে পড়ি।’
কল্পলোকেও
কলঙ্কভোগের বিছানা পাতা যায়। তারপর ঘুম। রাতে এক দৃশ্যের ভিতরে সুড়ঙ্গ খোঁড়ে অন্য
দৃশ্য। সেও কল্পলোক। সেখানে গান থেমে গেলে দেখা যায়--
‘রাগিণী ও আমির খুসরউ কয়েকটি কথা সেরে নিচ্ছেন;
মন বললে, তুমি সামান্য মানবসন্তান, পা বাড়িও না ওদিকে,
কিন্তু জেনো, ওঁরাও দুঃখ-দুর্দশার সুর বিনিময় করেন।
গান থেমে গেছে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, এবার
কোন রচনাশৈলীর সঙ্গে দেখা হতে পারে, ভাবি,
থেমে-যাওয়া গান, বাকরুদ্ধ বসন্তপ্রহর, ওই শোনো করুণাধারা
শীতলাতলা পার হয়ে, মোহনবাঁশি এগিয়ে আসছে
পুরু কাচের শার্শির পিছনে আমি যেন একা দাঁড়িয়ে, অবিরাম
হস্তপদ চালনা ক’রে, কত না ইঙ্গিতে, কাতর নৃত্যভঙ্গিমায়
জানাতে চাই, আজ কেমন ক’রে গাইছে আকাশ।’
কবিতার নাম
‘রিসালা’। মোহনবাঁশির এগিয়ে আসার বার্তায় কিংবা ‘হস্তপদ চালনা ক’রে, কত না ইঙ্গিতে, কাতর নৃত্যভঙ্গিমায়’ লেপ্টে বৈষ্ণবীয় অনুষঙ্গ। অথচ রিসালার
শরীরে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের পোশাক জড়ানো। এক খাত থেকে অন্য খাত। ‘ওঁরাও দুঃখ-দুর্দশার সুর বিনিময় করেন।’ আর গৌতম এই সম্মিলনে জড়িয়ে নেন
রবীন্দ্রনাথকেও। অনন্তের ঘ্রাণ এসে লাগে সেই আকাশে...
গৌতম সহজ কবি
নন। তাঁর কবিতার জগতও সহজায়ত্ত নয়। সেখানে প্রবেশের আগে প্রস্তুতি প্রয়োজন,
অপেক্ষারও প্রয়োজন। ‘পটনার মতিচন্দ’-এর নরকে পা রাখতে গেলেও কান তৈরি করতে হবে।
কবিতার পাঠেও এখানে অনায়াসে মিশে যাবে সুর। দুটো পা মুছিয়ে কেউ চটিয়ে পরিয়ে দিলে
সময় হবে উচ্চস্বরে গান গাওয়ার। দেবদূত আর যমদূতের বিনিময় হবে সেই সুরে। গানের কলির দিকে তাকালে
মনে হবে, ‘যেভাবে সর্বপ্রথম নরকের সঙ্গে /দেখা
হয়েছিল কুয়োতলায়, ফিরে এসেছে হাড় হিম-করা প্রতিধ্বনি’। ক্লান্ত
দেবদূত এরপর শুনবেন ‘আঈলন হো রামজী অয়োধ্যা মেঁ’। আর পাঠক
থই পাবে না কিছুতেই। কবিতা কি বোঝার জিনিস? গৌতম পরখ করবেন বারবার...
৪
এই লেখা যখন
শেষের মুখে, তখন সামান্য বিরতি নিয়েছে বৃষ্টি। বাড়িতে পোয়াতি ছাতিম গাছ। মশারির
ভিতরের লুটোপুটি খাচ্ছে গন্ধ। আর আছে শিউলি গাছ, তিনটে বেঁজি, বিড়াল... ছাদে বাগান
করেছে মা। এই লেখা যখন শেষের মুখে, তখন জ্বর ধুয়ে যাচ্ছে। গাছের গোড়ায় অযথাই জল আর অবান্তর নানা কথা ভেসে
যাচ্ছে খালি। বাঁধ দিয়েও আটকানো যাচ্ছে না। পাশে এসে বসছেন গৌতম। টেনে নিয়ে চলেছেন আখতারী
বাঈ-এর কাছে। এই লেখা শেষ হতে চেয়েও কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। এই লেখাতেও অনন্ত বুনে
দিচ্ছেন গৌতম বসু...
‘শেষ বাক্যে পৌঁছবার আগেই আপনি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেন,
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।’
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।’
নেতাজী কেবিন
.
.
গৌরবগাথা, এত ক্ষত, এত ক্ষতির দাগ
অঙ্গে শোভা পায়, সেই উপকূল থেকে আমি
এক আঁজলা রণভূমি তুলে এনেছিলাম
তোমায় খুঁড়ে তুলে এনেছিলাম, দাবানল;
দিবাস্বপ্নের বাঁশবনে, শীতলতম দিনে,
আমার শান্ত ঘুমঘোর চাদর মুড়ি দিয়ে
প্রেতের মতো কুয়াশায় এসে দাঁড়িয়ে আছে
অস্পষ্ট, অভুক্ত তোমার আমার পথশোক।
স্থান নেই গৌরবগাথায়, স্থান পেলাম না
পতিগৃহে, বুক-ফাটা বালুকারাশির মতো
ছড়িয়ে পড়েছি ফল্গুনদীর শয়নকক্ষে,
গর্ভদেশ থেকে বাতাসের ন্যায় জেগে উঠে
হতে পারি নি পরম, বায়ু; হাওয়ার অলিন্দ
থেকে ঝুঁকে প’ড়ে মেলতে পারি নি দুই ডানা,
আমার ভিতরের ঘরে আগুন বাড়ছে, হে।
অঙ্গে শোভা পায়, সেই উপকূল থেকে আমি
এক আঁজলা রণভূমি তুলে এনেছিলাম
তোমায় খুঁড়ে তুলে এনেছিলাম, দাবানল;
দিবাস্বপ্নের বাঁশবনে, শীতলতম দিনে,
আমার শান্ত ঘুমঘোর চাদর মুড়ি দিয়ে
প্রেতের মতো কুয়াশায় এসে দাঁড়িয়ে আছে
অস্পষ্ট, অভুক্ত তোমার আমার পথশোক।
স্থান নেই গৌরবগাথায়, স্থান পেলাম না
পতিগৃহে, বুক-ফাটা বালুকারাশির মতো
ছড়িয়ে পড়েছি ফল্গুনদীর শয়নকক্ষে,
গর্ভদেশ থেকে বাতাসের ন্যায় জেগে উঠে
হতে পারি নি পরম, বায়ু; হাওয়ার অলিন্দ
থেকে ঝুঁকে প’ড়ে মেলতে পারি নি দুই ডানা,
আমার ভিতরের ঘরে আগুন বাড়ছে, হে।
সেই তরবারির খোঁজে
*
সেই তরবারির খোঁজে, কত স্ফুলিঙ্গ কত অশ্বক্ষুর জ্বলে উঠেছিল,
সেই তরবারির খোঁজে কত রাত্রির
পাঁজর ভেঙে পড়েছে যন্ত্রণায়; জাগাে, জাগাে উষাকাল ।।
*
চিত্তরথ, এসো বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াই, ভীষণ নির্মম
হয়ে উঠেছে বৈদ্যকুল। সামান্য বাতাস চাই, সামান্য
ভ্রান্তি, সমাপনের নূপুরধ্বনি শােনার সামান্য জ্ঞান!
*
এই ঘোর অকালে, কে ও, নিজের পঙক্তির’পরে ঘুমায়?
দিনে-দিনে যে খসিয়া পড়িল রঙ্গিলা দালানের মাটি,
নিজের পঙক্তির পরে অঘােরে ঘুমায়, কে ও, ভাগ্যহীন !
*
গণহত্যার মতাে প্রবল বিশ্বাসে ছুটে চলেছিলাম।
তখন তুমিনাই,ভিজছে ভেড়ার পাল,বৃষ্টিধারায়,
অভিভাবক মাত্র একজন বালক, রয়েছে জগতে!
*
গরল,গরল,গরল,কেবল দেখি সেই নীল গ্রীবা
এতগুলি ভয়ানক খাদে কীভাবে সেজে আছে পৃথিবী!
বৃষ্টিপতন, ভীষণ ঝড়, আগুনের ঠিক মাঝখানে।।
*
পুব হাওয়াকে দোরে বসিয়ে মিষ্টান্ন কিনতে এসেছি।
আহা মূর্খ, নিজেই সুদীর্ঘ হাসি হাসলাম,উচ্চস্বরে,
পুব হাওয়াকে দোরে বসিয়ে মিষ্টান্ন কিনতে এসেছি!
*
মেঘের বক্ষ ও পিঞ্জর তােমায় কি কিছু বলে চলেছে?
গাছের ঝাঁকড়দা-মাকড়দা মাথা থেকে পাখির ঝাঁক,
এই দাহ্য নগরী ধ্বংস হবার অল্প আগে,উড়ে গেল ।।
*
যা ছিল সম্পূর্ণ হারাবার, তা এখনও হতশ্রী, উড্ডীন
ভাইয়ের রক্তপিত্ত মেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলাম,
কারা এসে বলল, এগিয়ে আসছে দূরের করতালি ।।
*
মাথায় সূর্যকিরণ, বহে চলি নদীমাতৃক ভেলায়
প্রভাতবেলার নাড়ি ছিঁড়ে, চলেছিহুতাশনের দিকে,
পক্ষীমাতা, আপনার সন্তানেরা গীত রচিল না কেন ?
*
অগ্নি জানালেন, তিনি ক্ষুধার্ত। এখন আমি কি করব?
অতঃপর শব্দ শুনি ইতস্তত : আমরাও, আমরাও,
এ আপনি কাদের টেনে আনলেন, গৃহস্থের কুটিরে?
নদীর বক্ষদেশ
.
.
জলের চেয়েও ক্লান্ত তার দেহের
’পরে ভোরের আলো এসে পড়েছে। জল তার দেহের চেয়েও ক্লান্ত, তাকে বহন করে, বহন করে সহস্র
কণায় চূর্ণ হয়ে-যাওয়া সূর্যালোক; জল নিজেকে বহন করে। ঘুম ফুরিয়ে গেছে বেহুলার, ঘুম
তবু শুয়ে রয়েছে তার কোলে, ঘুমের দুয়ারে আলো এসে পড়েছে।
নদীর পাড়ে যে জীবন সে ফেলে এসেছে,
তাকেও স্পর্শ করো রশ্মিসকল, সমস্তই অস্পষ্ট এই ভোরে; ঘাটের সিঁড়িগুলি একে-একে উঠে গেছে
কুয়াশার দিকে, সিঁড়ির ফাটলে হাওয়ায় কাঁপছে একটি চারাগাছ, সমস্তই স্বর্গের মতো নীরব।
দুঃখিনী আমাদের এই মেয়ে আর কোনওদিন এসে দাঁড়াবে না পেয়ারাতলায়, হাঁটবে না ভিজে ঘাসে,
যেখানে পাড়-ভাঙার শব্দ ডুবে যায় নদীতে, সেই কুয়াশায় গচ্ছিত রইল তার এই পৃথিবী।
সম্মুখে দেখা যায় সমুদ্রের মতো
নদী, আকাশের মতো সমুদ্র, ব্রহ্মাণ্ডের মতো আকাশ।
আনন্দগান
শ্রীমতী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়-কে নিবেদিত
.
.
ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকাণ্ড
সূর্যাস্ত
আমার প্রতীক্ষাটুকু মাটিতে পেতে দিলাম;
বন্ধুর পথ অজানা, বন্ধুর ঘর জানি না
ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকাণ্ড সূর্যাস্ত
আমাদের আয়ুষ্কাল মাটিতে পেতে দিলাম;
হলো না সত্যদর্শন, ভেঙে গেছে হোলিখেলা
ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকাণ্ড সূর্যাস্ত
আমাদের প্রেমকথা মাটিতে পেতে দিলাম।
আমার প্রতীক্ষাটুকু মাটিতে পেতে দিলাম;
বন্ধুর পথ অজানা, বন্ধুর ঘর জানি না
ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকাণ্ড সূর্যাস্ত
আমাদের আয়ুষ্কাল মাটিতে পেতে দিলাম;
হলো না সত্যদর্শন, ভেঙে গেছে হোলিখেলা
ধ্বংসের পায়ের তলা আর প্রকাণ্ড সূর্যাস্ত
আমাদের প্রেমকথা মাটিতে পেতে দিলাম।
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার
গৌতম চৌধুরী
চৈত্র ১৪১২-র এই মধ্যরাতে
বিশ-তিরিশ বছর আগেকার ডাঁইডাঁই কবিতাবইগুলির বহর থেকে সামান্য
প্রয়াসে অবশেষে বেরিয়ে এল ২২টি কবিতার সেই কৃশ সংকলনটি, যার শরীরে
আপাদমস্তক কীটদংশনের সাক্ষ্য, কিন্তু আত্মার বিদ্যুৎ আজও মর্মবিদারী। বাঙালি মধ্যসত্ত্বভোগীর ৬০-৬৫ বছরের জীবনে ২৫টি বছর হয়তোবা বড় সামান্য
নয়, যেখানে তার সৃজনশীলতার সর্বাধিক আত্মমুগ্ধ পরিসর অদ্যাবধি
কবিতায় এবং তত্রাচ বিফলতা ও সাফল্যের পাথরফলকও রাশিকৃত। উৎসবের এই ভূরিপরিমাণ আলোকমালা ও আবর্জনার অন্তরালবর্তী কোনও অনুচ্চকিত স্তব্ধসংগীতের
ঐশ্বর্যে শ্বসিত হয়ে ওঠার জন্য, একটি কাব্যগ্রন্থের পুনর্পাঠে ২৫বছরের ব্যবধান যে কত ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারে,
প্রিয় পাঠিকা-পাঠক, তা অভিজ্ঞতায়
আনার জন্য, আসুন, আরও একবার পাঠ করি সবুজ
প্রভাবতী কাগজে আরও সবুজ রঙে কাঠখোদাই ব্লকে ছাপা প্রচ্ছদে মোড়া সেই অমোঘ কবিতাবইটি,
গৌতম বসু প্রণীত অন্নপূর্ণা ও শুভকাল (বং
১৩৮৮)।
কিছু কিছু ফুল থাকে
যার পূর্ণ উদ্ঘাটিত রূপে-ঘ্রাণে আমরা বিভোর হই। তার রঙের ছটায় ছটায় আগুনের নিশান ছড়িয়ে পড়ে আমাদের হৃদয়ে। আবার কিছু ফুলের আমন্ত্রণ যেন তার না-ফোটা রহস্যে, রাত্রি পোহালে ফিরে ফিরে গিয়ে
দেখি আরও কতদূর ফুটে উঠল সে-ফুল। যতবার ফিরে ফিরে যাই, সে যেন একটু একটু ক’রে মেলে ধরে তার অরূপ। অন্নপূর্ণা ও শুভকাল-এর কবিতা এই দ্বিতীয় গোত্রের। এবং কী আশ্চর্য, গত ২৫বছরে
বাংলায় কত কত জাদুকরী কবিতা লেখা হ’ল,
অত্যাশ্চর্য ছন্দমিলের, নাটুকে গদ্যের,
সারিবাদি, নারীবাদী, তন্ত্র-মন্ত্র-পপ-অপ কিছুই বাকি রইল না,
কিন্তু এই বৈদ্যুতিন কবিতাগুলির অমোঘতা কিছুমাত্র শিথিল হয়নি আজও। কালের প্রহার জারণ ক’রে তা বরং আরও দূরপ্রসারী হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
একেকটি কবিতার দিকে
চুপচাপ তাকিয়ে থাকি। চোখে পড়ে ছোট ছোট পংক্তিগুলি, তার ভিতরের কমা-সেমিকোলনগুলি। এইসব উপযতির মধ্যবর্তী উচ্চারণগুলি, প্রেরিত নিমগ্ন বাক্যাংশগুলি,
রহস্যের পাপড়ি একেকটি। স্তব্ধতার একেকটি সিঁড়ি। ২৫বছর আগেকার কোলাহলের গৌরবগাথার প্রান্তরে গৌতম বসু যেন গ্রহান্তর থেকে নিয়ে এলেন
এই স্তব্ধতার অভিব্যক্তি –
প্রত্যাবর্তনের জন্য ঘাস, এই নিশীথে
যাদের কেতন ছেঁড়ে, তারা
যায়
জনৈক আত্মঘাতীর শেষদিন শান্তিময় ছিলো
...
বিসর্জনের পরিবর্তে কারা গাছতলায়
নারী ও বাহন রেখে গেছে...
...
জরি লুটোয়, বুকের খড়
পচে গেছে
ভীষণ চুল, শোকে পাগলিনী।
হয়তো সম্পূর্ণ গ্রহান্তর
থেকে নয়। হয়তো কোনও এক কমলকুমার, কোনও এক আলোক সরকারের কাছে সঙ্গত কিছু
প্রাপ্তি ছিল তাঁর। তবু, তাঁর প্রাতিস্বিক ধীরনির্মিত নয়। বরং যে-ঐতিহাসিক ভূমিকাটি
তিনি পালন করতে এসেছিলেন, তার পূর্ণ সচেতনা-প্রস্তুতি-মর্মজ্ঞান-সংবেদন ও দূরদৃষ্টি
নিয়েই তিনি পথিকতায় ব্রতী। সে-সূত্রপাতে কোনও সারল্যের ভণিতা নেই। গ্রন্থের ১ম কবিতাতেই সেই স্বীকারোক্তির শ্রীজ্ঞান আমাদের স্পর্শ করে যায় – ‘জলের পরিবর্তে এই শ্রাবণ/আর সহজ নয়,/ভূমি হয়ে উঠেছে হতশ্রী বাহু/দক্ষিণ, ক্লিন্ন গৃহশেষের শান্তি’। এবং, গ্রন্থসমাপ্তিতে
পাই সেই অমোঘ আত্মজ্ঞানের উচ্চারণ, যা একমাত্র কোনও মহৎ কবিই
উপলব্ধি করতে পারেন – ‘যে জানে শেষাংশ কিভাবে গীত হবে সেইজন সমাপ্তির
রাজা/সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা…’। মনে হয়, করতালিমুখর বাঙালি
বাবুবিবিতন্ত্রের যে-অবসান আজও প্রতিভাত হচ্ছে না, শুধুই গোধূলিসন্ধির সামান্য নৃত্যমাত্র দেখা যাচ্ছে, বসু তা টের পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর অতিতারুণ্যেই – ‘এদের
আরোগ্য দুরূহ, দুরূহ ওই সেবিকার ব্যস্ততা/রাত বেশি নয়, মনে হয় আরো দুর্নিরীক্ষ্য রাত’। অথচ তাঁর উদ্বেগ যে অব্যবহিত সমাজকে নিয়ে এমন নয়, তবু উদ্বেগ রয়েছে। তাঁর উদ্বেগকে তিনি স্থাপন করেছেন এক আবহমান কালের মাত্রায়। নিরন্ন কৌমের অতিবাস্তবতা তাঁর কাছে কোনও সাগরপারের আলোকায়নপ্রেরিত বার্তা নয়। বরং বাঙালি অন্নপূর্ণার রূপকল্প যে-অন্ন-অপূর্ণতা থেকে সম্ভূত, তিনি তাকেই স্পর্শ করতে চেয়েছেন –
১. ধানও শিশুর উন্নতি ঘিরে
অনেক বার্তা পার হ’লো, বহু হাওয়ার দিন
২. ... সবই আছে, কিন্তু এমনভাবে,
ভাতের হাঁড়ির নিচে
আগুন নেই, জল
নদীতে জল নেই,
আগুন; উদ্বেগ এই জন্য।
৩. জেগে উঠে দেখবে পথে বিপথে অন্নের থালা
থালার বৃত্তাকার ক্ষুধা
৪. জল স’রে যায়, মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত
এত বেশি সরে
যে দুর্দিন
এই দুর্দিন,
এই উদ্বেগ, এই অন্ন, এই ক্ষুধা,
আজকের, তবু শুধু আজকের মাত্র নয়। তা বিস্মৃতির গভীরে তলিয়ে যাওয়া কোনও এক সুদূর প্রহর থেকে ভেসে আসছে যেন, যেন তা ভেসে আসছে অনাগত কোনও ভবিষ্যতের
গর্ভ থেকেও। শারীরিকভাবে সংলগ্ন একটি ছোট্ট মুহূর্তের কেশরাশিতে
তিনি যেন বহিয়ে দেন এক বড় মুহূর্তের বাতাস। তাই, একটি ঘুড়ির পিছনে ধাবমান বালকদের কোলাহলের
আড়ালে ধরা পড়ে ‘অবিমিশ্র কোলাহলের কাল’। বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকা শিশুটির ভয়ের উন্মোচনে দেখা যায় ‘প্রথম রহস্য/অথবা
সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা’।
আকাশ-পাতাল-বিথারী চোখ নিয়ে বসু দেখে গেছেন সময়ের সাথে সময়ের
সীবনের এই রহস্য। কতনা ভয়ঙ্কর সেইসব দর্শন – ‘গহনার সব ধ্বনি ঝরে গেছে’,‘কন্যার গভীর রঙ/শাড়ি থেকে খসে পড়েছে, রঙ মৃত্যুবাহিনী নদীর’। ‘পড়ে আছে/কংসাবতী, প্রাণদায়িনী, অবিকল শকুনের
ঘাড়’। কিন্তু বসু তো শুধু এই সব নিঃশব্দ অভিনয়ের দর্শকমাত্র
নন, তিনি তো প্রদর্শকও একজন। হয়তো নিজেকে দিয়েই তিনি বুঝেছেন –
‘দর্শক লতার কঙ্কাল, দর্শক/তার নদী হওয়ার সম্ভাবনা’। আর এই সম্ভাবনার সম্পূর্ণ
সার্থক প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তিনি টের পান, ‘শব্দও একপ্রকার অন্ধকার’।
শব্দ একদিকে যেমন অন্ধকার,
তাই স্বপ্নগর্ভ, অন্যদিকে সে আবার শৃঙ্খলও বটে
– ‘শিকল দেখে আবার মনে পড়লো শব্দের কথা’। কিন্তু এই শিকলকে জলে রূপান্তরিত করার জন্য বসু এক অভাবিত কৌশল অবলম্বন করেছেন, নির্মমভাবে ছেঁটে দিয়েছেন শৃঙ্খলসৃষ্টিকারী
ক্রিয়াপদগুলি –
সমুদ্রের জন্য নিবেদন
ভূমিষ্ঠ হ’লো, ধ্রুব সমাপ্তি;
অবিশ্রান্ত এই তৃণ, অমূর্ত;
জেগে রয়েছে উদার ভূমি
একটি কণ্ঠ, একটি নৈঃশব্দ।
অবিরত সম্ভাবনায় এক আরম্ভ
সংহার এগিয়ে চলেছে,
দুলে ওঠে ধুলোয় ঘেরা মফঃস্বল শহর
সকল সজলতা পার্শ্ববর্তী।
৯পঙ্ক্তির একটি কবিতায় ৩৫টি শব্দ, ৪টি মাত্র যৌগিক ক্রিয়া। এই বি-ক্রিয়াকরণের ফলে
একদিকে যেমন বেরিয়ে আসে শব্দান্তর্গত গহন অন্ধকার, যা এক মর্মান্তিক
আলোর জন্য নিদ্রাহীন, অন্যদিকে ঝরে যায় তার শৃঙ্খল, ন্যায়ের অভ্যস্ত ভঙ্গিমা। গড়ে ওঠে বিন্যাসের এক বহুমাত্রিক
অভিঘাত। স্ফুরিত হয়ে ওঠে এই অমোঘ উচ্চারণগুলি –
১. ঐরাবতের এই বুঝি শেষ হিংস্র দিন, ঘাসের
পায়ে অন্য ঘাসের মাথা
২. দানশেষের দারিদ্র্যের নিচে একাকী কৃষাণ
শস্যের ধর্ম,
শস্যের অনিশ্চয়তা।
৩. পৃথিবীর প্রতি বার্তা কিছুদূর আলোকিত
আলো অথবা হলুদ করাত।
এবং, সেই বাক্যটি,
যা ইতোমধ্যেই প্রবাদে পরিণত হয়েছে –
৪. এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।
ক্রিয়াপদের এই অপ্রতুলতাকে
অবশ্য নিছক এক প্রাকরণিক কৌশলমাত্র ভাবা ভুল হবে। অন্নপূর্ণা ও শুভকাল-এর অভিব্যক্তির এটি এক সামান্য লক্ষণ যা বসু-র সংহত সংযত
চারিত্র্যেরই প্রকাশ। কবিতাকে এক চূড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছে দিতে হবে বলেই
তিনি যেন প্রবল মিতভাষী।
এ এক আশ্চর্য ঘটনাপরম্পরা
যে, এহেন সংযমী কিংবদন্তীর পরবর্তী দুটি কবিতাবই প্রকাশ পেল ঠিক
১০বছর অন্তর অন্তর – অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে (বং ১৩৯৮) ও রসাতল (বং ১৪০৮)। এ দুটিও বাংলা কবিতার দুটি অসামান্য সংযোজন। তবু যে এই ক্ষুদ্র গদ্যে অন্নপূর্ণা ও শুভকাল প্রসঙ্গেই কিছু শ্রুতিচারণ
অনিবার্য হয়ে উঠল, তা শুধু
তার প্রথমতার অভিঘাতের শিহরনমালা পুনরনুভব ক’রে। আধুনিকতা-লাঞ্ছিত বাংলা কবিতায় এই শীর্ণ কবিতাবইটি অত্যন্ত নীরবে ও নিরহঙ্কৃতভাবে
এক অন্যতর জীবনবোধ ও কাব্যবোধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল এমনই এক তীব্রতায়, যা পরবর্তী চর্চার সঞ্চারপথকেই পুনরভিষিক্ত করেছে।
সেই আনন্দযাত্রার সহমর্মী
হিসাবে, প্রিয় পাঠিকা-পাঠক, আসুন, আমরাও গৌরবান্বিত হই আজ। প্রশংসাবিমুখ এই মানুষটিকে বিব্রত ক’রে অন্তত একবার তাঁর নামে নির্মল জয়ধ্বনি দিই।
বাক্-এর জন্য একটি নতুন লেখা
এ-বছর দেবীবিসর্জনের পর
গৌতম
বসু
লরিতে প্রতিমা
তুলে নিয়ে যাওয়ার পর, চৌকির ওপরে, দেবীমূর্তির জায়গায় রঙ-করা মাটির যে পিলসুজ ও
প্রদীপ রেখে যায় পাড়ার ছেলেরা, সেটি নিভে তো গেছেই, লক্ষ করলাম, ততদিনে তৃষ্ণার্ত
মাটির প্রদীপ সমস্ত তেলও শুষে নিয়েছে। সন্ধ্যাকাল। চৌকির এক কোণে বসতেই মচ্ ক’রে
একটা শব্দ হল। চারপাশে তাকালাম, ত্রিসীমানায় কেউ নেই। পার্কের ওদিকটায় একটা নিঃসঙ্গ স্ট্রীটলাইট দাঁড়িয়ে
রয়েছে বটে, ওই পর্যন্তই। প্যান্ডেল যে এতটা বড় আর উঁচু, বুঝি নি এর আগে, মনে-মনে
ভাবছিলাম। অংশত বিবস্ত্র ক’রে তাকে, কে জানে, কোথায় চ’লে গেছে ডেকোরেটারের লোকজন।
আগামীকালই হয়তো তারা ফিরে আসবে,
আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে এই জায়গা, হয়তো অস্থায়ী এই দেবালয়, এভাবেই, মহাশূন্যের
মতো পরিত্যক্ত অবস্থায় প’ড়ে থাকবে আরও কিছুদিন। আধপোড়া বিড়ির একটা টুকরো দেখতে
পেলাম ঘাসে। চণ্ডীর চার নম্বর অধ্যায়ের ‘চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা’ মনে
পড়ল হঠাৎ, কিন্তু পরের লাইনটা? একটা দীর্ঘ, সরু টানেল দিয়ে যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে
চলেছে সে, দূরে, আরও দূরে, আর সেই আধো-অন্ধকারে অসহায়, আমি তাকে ডাকছি।
শতপুষ্পসুগন্ধবাহী বাতাস প্যান্ডেলে প্রবেশ করা
মাত্র আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম। এক নিমেষে চৌকি ছেড়ে ঝপ্ ক’রে মাটিতে হাঁটু গেড়ে ব’সে
পড়লাম । চোখ বুজে রয়েছি, কিন্তু ক্ষীণতম শব্দ থেকে সূক্ষতম চক্ষুশিখাটি, টের
পাচ্ছি সমস্তই। সিঁদুরের টিপ-পরা টিনের খাঁড়াখানা আবির্ভূত হয়েছে, তার তপ্ত
নিঃশ্বাসের বেগে আমার মাথার চুল উড়ছে। নিশানা ঠিক ক’রে নেওয়ার জন্য অনিশ্চয়তায়
কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত, তারপর আলোকরশ্মির বেগে, সক্রোধে সে নেমে এল আমার দিকে,
আমার তলপেট চিরে ফেলে, বিজয়গৌরবে হাঁপাতে লাগল।
![]() |
চিত্রঋণ : তিব্বতী থাঙ্কা পেইন্টিং |
“শেষ বাক্যে পৌঁছবার আগেই আপনি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেন,
ReplyDeleteআপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার" অবাক হলাম এই কবি গৌতম বসুকে নতুন করে জেনে। কী অনুপম নির্মেদ বাক্যের শরীর । বাচ্যার্থও বড় নির্ভার। জীবনের গতিময় ক্রিয়ায় কবিতার সিদ্ধি খুঁজতে হয় কীভাবে তা তিনি জানেন। তাঁর গদ্যের চালের গরিমায় নিজের জীবনের আলো দেখতে পাই। গতানুগতিক পথে না গিয়ে কীভাবে সমষ্টিচৈতন্যেই তুমুল সহবাস তুলে আনা যায় তা তিনি বলে দিয়েছেন। যোগ্য এই মানুষটির জন্য শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা রইল।
অভিভূত ! এক কবির চোখ দিয়ে আরেক কবির জয়গান। অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের নন্দনতত্ত্ব। শ্রদ্ধা জানাই দুই কবিকেই। পরম প্রাপ্তি।
ReplyDeleteএই কবিতার কাছে বসে থাকা অনন্তকাল ধরে। আলোচনাগুলিও চমৎকার লাগলো।
ReplyDeleteঅনবদ্য আয়োজন।
ReplyDeletekhub vaalo laglo.
ReplyDeleteচোখে পড়ল। ঢুকলাম। আজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকল। এই কবিকে আরো জানতে চাই।
ReplyDelete