Sunday 20 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। শুভদীপ নায়ক



কাঠুরেদের কবর


কাঠুরেদের প্রতি এতকাল শ্রদ্ধা ছিল  
তাঁরা অরণ্য কেটে ঘরবাড়ি আর বসতি
গড়ে নিয়ে ভেবেছিল শহরতলির জীবনে
এনে দেবে কাঠের আগুন রান্না হবে
আশ্চর্য নক্ষত্র যার ভিতর-কিনারা দিয়ে
অনাবিষ্কৃত গাছেদের কুয়াশাশরীর দেখা যাবে
চাই অভ্যন্তরের বিষ স্বচক্ষে স্বকর্ণে ঝুলে
বিঁধে থাকতে থাকতে পাতার উল্টোদিকে
পালকের ডগা দিয়ে কালির কবিতা লেখা শুরু
ঈশানের কবিতা শ্বাপদের কবিতা বন্দি
শিবির থেকে তালা ভেঙে কয়েদিরা ছুটে আসে
তাদের পালিয়ে যাওয়া কবিতারা সিঁড়ি
বেয়ে একদিন উঠে এল রানিদের খাসমহলে


এখান থেকে চুরি গিয়েছিল কাঠের সর্বস্ব পর্দার
আড়ালে প্রেমিক-পোষা যুবতীর ভুল বিশ্বাসে
যাকে গোপনে ধ্যান করো সেই শিখা
মাটির সরার গায়ে বেড়ে ওঠে ধুনো পুড়িয়ে
শ্বেতমাছের সন্ধানে জলাশয় গভীর
হয়েছে জেনেও তাতে ডুব দিতে যায় রোজ
মরা প্রজাপতি বন থেকে উড়ে গেলে
উৎসব বা আচ্ছাদন কেটে দুমুঠো সবুজ ঘাস
রাতভোরে ফিরে আসে রক্তের গভীরে


পথে পথে কুকুর ডেকেছে রান্নার হেঁসেলের
আশেপাশে বিদ্রুপ ছড়িয়ে কালো পোড়া 
পাউরুটি ঝাউবন আজ যাঁরা কারুণ্যে জীবিত
অর্ধনগ্ন সেইসব কাঠুরে কবিদের পাশে খেলনা
ছাড়া আর কিছুতেই কিছু বেঁচে নেই
নতুন দালান তৈরি করেছে এই কারাবাসী
ধূর্ত মাছিরা গাছের ছালের মতো বিশুষ্ক 
কাঠ কেটে দরদামে তুলে দেওয়া ব্যাপারিদের
দোকানে হ্রদের প্রতিফলন জুড়ে দৈত্যশিশুর
মতো নতুন সাহিত্যপত্রে শহর গড়েছে যাঁরা
একদিন কাঠ কেটে বাড়িঘর গড়েছিল
নদি থেকে জল তুলে সঞ্চিত পাথরের জীবনে
পলির ফসল ভেবে ঢেলেছিল ঊষর আবেগে
কাঠুরেদের প্রতি আর শ্রদ্ধা নেই মোমবাতি জ্বেলে
বসতির সব লোক বসে আছে সমাধির সম্মুখে 



দরজা

বন্ধ দরজার ওপাশে একদিন ডেকে নিয়ে
বুকের কৌটো খুলে দেখিয়েছিলে পর্বত-নদি-নালা। 
সুউচ্চ দুটো টিলার ওপরে বাঁধা গবাদিপশু,
ঘাসগুলি বৃত্তাকারে খেয়ে ফেলেছে।  দড়ির
বাঁধন ছিঁড়ে কোনখানে চলে যায়নি কেউ। 
আরেকদিন দুপুরে হাত ধরে টেনে এনেছিলে আঙুরখেতে
থোকাথোকা পুঞ্জীভূত মেঘের দলা আর বৃষ্টির
রস জমে বাঁধের প্রাচীর যেন বিপর্যস্ত হয়েছে।
পরকলা মেঘ অশোভন ঘরের সেই অন্ধকার কোণ
আর আচ্ছন্ন দুজনে পুরনো প্রেমের মতো ভালবাসাবাসি
হঠাৎ নতুন করে এইবার শরতের প্রথমে শুরু।
শীতল মেঝের ওপর ঝরে পড়ল শাড়ি, হাত দুটো
ধরে নিয়ে বললে, ‘তুলতে হবে না।বিনারন্ধ্রে
এতকাল আঁটোসাঁটো ব্লাউজ এই প্রথম অনায়াসে
খুলে দিল তালা, বৈদ্যুতিক ঝংকারে বেজে উঠল
কেঁপে উঠল আত্মা, পুনরায় দরজা বন্ধের আগে। 



ব্রোথেল

পাখিদের জন্ম শুরু হল, শুরু হল আমাদের ইতর অভ্যাস। ব্রোথেল, এমন বৃষ্টির দিনে তুমি ফিরে এসো মর্মর বিছানায়। প্রেমিকার স্তনগুচ্ছে চুমু খাও,— কাহিনি, চিত্রনাট্য, প্রিয়জনের সাক্ষাৎ, এইসব আজ বাইরে অপেক্ষা করুক। 

প্রস্তাব আর খণ্ডের মাঝে দিন পেরিয়ে গেছে। অফুরন্ত বাসনা ছিল, ফলের বাগান থেকে ইচ্ছেমতো পেড়ে আনা যেত তাকে। এই দ্যাখো আজ হলুদ পরেছি, পিঠ থেকে খুলে নিতে পারবে, নামিয়ে রাখতে পারবে দুজনের ছেদ সীমানার মাঝে, বাথটবে সাবানের ফেনায়, জলীয় আশ্বাসে, ছুরির ফলাতে কাটা শশার টুকরোয়, আমার মধ্যে রাত্রি নেই, নীহারিকা আছে, ঠোঁটতারই অক্ষত আগুনে তেত্রিশ বছর ধরে জ্বলছে। 



ক্যানভাস


প্রতিহিংসার দিকে যখন এগচ্ছি, ক্যানভাস বিনা শব্দে আহত তুলির টানে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সিংহাসনের ওপর ডানাওয়ালা উলঙ্গ শিকারি, পায়ের কাছে বসে আছে যে পূর্ণাঙ্গ যুবতী শিকারির বর্শা তাকে বিদ্ধ করেছে সোহাগে। উদাসীন পদ্মের দিঘি অনুতপ্ত আলো নিভিয়ে ফিরে যাচ্ছে শয়তানের গৃহে, ছিন্ন আলো বিকেলের দিকে কমতে শুরু করেছে । এই কি নরকলোক? নুনে ভরা দেহ? কূটকৌশলময় ধোঁয়া? অনামা ঝিলে আজ মাছেদের নতুন অতিথি, সেইসব আঁকা ছিল ছবিতে, অবকাশে। ডানার সঙ্গে জর্জরিত বিষের রঙ ছিল গোলাপি, মৃত্যুর ঠিক কোনদিকে সবুজ রঙের এত ভয়াবহ ব্যবহার আমি চিনিনি। নির্যাতিত আঙুলের মতো তুলি আর রঙের মাঝখানে পড়ে ছিল চেতনা চিনির দানার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো অনিশ্চিত জীবন নিয়ে। 

1 comment: