Tuesday 22 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। সাহিত্য আলোচকের রাজনীতি নিয়ে বলছেন শতানীক রায়



আলোচনা, আলোচক এবং রাজনীতি

আসলে আমি নিজে একজন আলোচক হিসেবে রাজনীতিতে বিশ্বাসী। প্রসঙ্গে বলা যায়, আলোচক হলেন আপাত অর্থে রাজনৈতিককর্মীর মতো যে কোনো না কোনো দলের বা গোষ্ঠীর লোকেদের গুণগান করবেন (এটা সর্বার্থে সত্য নয়, সমাজ সংস্কৃতি এবং সময়ের নিরিখে বদল এবং পাশাপাশি এর ব্যাতিক্রমও ঘটে)। তবে সমালোচক বা ক্রিটিক হলেন সেইজন যিনি তাঁর অবস্থান থেকে কোনোভাবেই নড়বেন না। আজ হঠাৎই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসলাম আরকী। একটি সম্পাদিত বইয়ের আলোচনা করেছেন একজন পাঠক ফেসবুকে। আসলে তিনি শুধু পাঠক নন লেখকও বটে। পাশাপাশি সম্পাদকও। উনি আলোচনাই লিখেছেন বটে, আরেহ! না, তিনি ইতিহাস লিখেছেন বোধহয়। ঢালাও তালিকা দিয়ে দিয়েছেন বইয়ের সূচির। সেখানে কারো লেখারই আলোচনা করেননি, শুধু কয়েকটি লেখাকে আলাদা করে উল্লেখ করে ভালো বলেছেন। এটাকে রিভিউ বলে এখন চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানছি কোনো কিছুই ভুল নয়। আরে! এই ‘ভালো’, ‘অসাধারণ’, ‘বাহ/বাঃ’, এসব ইত্যাদি শব্দগুলোও এখন রাজনৈতিক স্তাবকদের মতো শোনায়, শেয়ালের পো-এর মতো। গত মাসে আমি একজনের পোস্টে গিয়ে মন্তব্য করে বসলাম বড়ো প্রবন্ধ লেখো, তার উত্তরে ব্যঙ্গকৌতুক ফেরত পেলাম যার প্রতুত্তরে আমি তার লেখকসত্তাকেই নাকচ করে দিই। আমি দেখলাম অযৌক্তিকভাবে কিছু অন্ধভক্তেরা এসে আমাকে জ্ঞান এবং অসূয়ার পাঠ শিখিয়ে গেলেন। ‘উৎপলকুমার বসু নাকি কোনো কবিতায় বলেছেন যে, প্রবন্ধ লেখা জঞ্জাল।’, এমন কথা বলে বসেছিলেন একজন, আমি সেই কবিতা পড়িনি কিংবা সেই উক্তির প্রেক্ষাপট জানি না আর জানলেও আমাকে সেটাই গ্রহণ করতে হবে কে বলেছে। এমন রাজনীতি থেকে না হয় দূরেই থাকলাম। আরে আমি কোনোমতেই ক্ষুব্ধ হইনি। অবাক হলাম, আমাদের মধ্যে শিক্ষানবিশ হওয়া ও পারস্পরিক সম্মান ক্লিশে হয়ে যায়। সেজন্যই বলি, আমি আলোচকের ভেকধারী একজন ক্রিটিক।        
একটি খ্যাতনামা পত্রিকার সম্পাদক আমাকে একবার একটি বই সম্পর্কে আলোচনা করতে বলেন। আমি আলোচনা লিখে জমা দিই। পত্রিকা হাতে পাওয়ার পরে দেখি, সেখানে একজন লেখক আরেকজন সমকালীন লেখকের বই সম্পর্কে আলোচনায় সবখানে শুধু ‘মহৎ বই’ শব্দ দুটো বারবার ব্যবহার করেন। পড়তে ভালোই লেগেছিল লেখাটা তবে বলি কি, একটি প্রশ্ন জেগেছিল মনে, বইটি সম্পর্কে আলোচনাই লিখলেন তবে অত মহৎ মহৎ বলবার কী আছে বুঝতে পারলাম না। মানছি উনি সমালোচনা লেখেননি, লিখেছেন আলোচনা। এমন অবস্থানে উনি চাইলেই মহৎ শব্দটি এড়িয়ে যেতে পারতেন। আলোচনার গঠনেও অনেক বিস্তর ফাঁকি লক্ষ করি। রোলাঁ বার্ত তো ‘S/Z’ বইতে বলেছেনই, আমরা এখনও বই পড়তেই শিখিনি। আমি নিজেও এটা মনে করি। ভাষা যেখানে স্বয়ং ডিসকোর্সের ফসল এমনকী মৌখিক ভাষা পর্যন্ত মানুষ হিসেবে বা একই মানুষের বিভিন্ন তলে সময়ের খাঁজে খাঁজে মিশে গিয়ে বদলে যায়। আসলে, মূলে কোনোই পার্থক্য থাকে না যা হয় সেটা অবচেতনে বিষয় এবং পরিস্থিতিতে পড়ে প্রকাশভঙ্গির তারতম্য ঘটে। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে অত সহজেই কি আমরা কোনো কথাসাহিত্য সহজেই জল খাওয়ার মতো পড়ে ফেলতে পারি? যখন পারি না তবে বুঝতে হবে, আমাকে এখন এমন এক নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, যেখানে ক্রমাগত অর্থ উদ্ধার করতে করতে না এগিয়ে পড়ার সময় তার অবস্থান এবং ভাষার নিরিখে কোন কোন পরিস্থিতি তার বিষয়কে পরিস্ফুটিত করছে তার উন্মোচন করা যার জন্য প্রয়োজন এমন একটি পাঠ যার মধ্যে পাঠক সততই নিজেকে জানতে জানতে এগোবে যে, সে কতটা এই পাঠ থেকে নিজেকে জানতে পারছে বা নিজের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করতে পারছে এই লিখিত বিশ্বকে। আলোচনার নিরিখেই তখন যা উঠে আসবে তা হল নিরীক্ষা এবং সমালোচনাকে দূরে রেখেই তা এগোবে এবং আলোচকের নিজস্ব বিশ্বে তা মিশে গিয়ে কীভাবে একটি স্বতন্ত্র গদ্যলেখ হয়ে উঠবে তার নিদারুণ দেওয়া তখন সেই আলোচনার যিনি পাঠ করছেন তার উপর এসে বর্তাবে। 
আমি কোনোভাবেই আলোচকের রাজনীতিকে খর্ব করতে চাইছি না। পরিচয় পত্রিকার ৮ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, ভাদ্র, ১৩৪৫ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বরবিতান’ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা বেরিয়েছিল। আলোচনা করেছিলেন হেমেন্দ্রলাল রায়। এমন আলোচনা আমি খুব কমই পড়েছি। কোনো অযথা গল্প বলছেন না তবে তাত্ত্বিকভাবে যা বলেছেন তা খুবই পরিমিত। লেখাটি যেখানে শেষ হওয়া প্রয়োজন ঠিক সেখানেই থেমে গেছে। এটাও তো আলোচকের রাজনীতির অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারি কারণ, এখানে না আছে কোনো স্তবগান বা অযথা স্তুতি বা অযথা কোনো গল্প তৈরি করার প্রচেষ্টা। এমন রাজনীতির ফলস্বরূপ লেখক পক্ষপাতে না গিয়ে সরল কিছু ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন বইটা সম্পর্কে। আমার এক বন্ধুর সুবাদে অরূপরতন বসুর ‘মাল্যবান’ সম্পর্কে আলোচনা ফোনে অনেকটাই শুনেছি। এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান’ উপন্যাস আলোচনা করতে গেলে যে-ডিসকোর্স এবং শিক্ষা, সঙ্গে পরিণত মনস্কতার প্রয়োজন তা ওই আলোচকের যথেষ্ট আছে বলেই ওরকম উজাড় করা লেখা লিখেছেন যা আপন শক্তিতেই একটি আলাদা টেকস্ট হয়ে উঠেছে। গতবছর দমদম জংশন পত্রিকার গঠনবাদ, প্রতি গঠনবাদ ও উত্তরগঠনবাদ সংখ্যায় কৌশিক সরকারের গঠনবাদ বিষয়ক লেখা পড়ে আশ্চর্যের থেকে অনেক বেশি আহতও হয়েছিলাম। কোনো তত্ত্বের কচকচানি করে আলোচনার পঠনপ্রক্রিয়াকে ব্যহত করেননি। পাশাপাশি নিজের একটা স্বয়ংক্রিয়তা বোঝানোর জন্য নিজেকে ক্রমাগত একটি তৈলচিত্রের হয়ে ওঠার মতো নিজের কথা বলে গেছেন। তা প্রচণ্ডভাবে লুনাটিক কোনো কিছুর ধার না ধরেই উনি বলে গেলেন লেখায় কাউকে শোনানোর প্রয়োজন মনে করেননি এর মধ্যে আত্মকথনের রীতি থাকলেও তা রীতিমতো তত্ত্ব থেকে বিচ্যুত হয়নি। এখানে নিজের অবস্থান আলোচক হিসেবে দেখানোটাও তাঁর একটি রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে আমি মনে করেছি। আহত হয়েছিলাম তার নতুন কথনরীতি এবং রাজনীতি লক্ষ করে।                                                                    
আরও কিছু রাজনীতি চোখে পড়ে ইদানীং ফেসবুকে এবং নানান পত্র-পত্রিকায়। ফেসবুকে অধিকাংশ মানুষেরাই যে-সব বই নিয়ে আলোচনা লেখেন তার অধিকাংশই একে-অপরের সম্পর্ককে আরও নিগূঢ় করবার জন্য। সেটা পত্রিকায় আলোচনার ক্ষেত্রেও। তবে এ কোনো আশ্চর্য হবার বিষয় নয়। আমার চোখে আরেকরকম রাজনীতি চোখে পড়েছে যা হল, কিছু সৃষ্টিশীল লেখক নিজেদের চিন্তা এবং লেখার গঠনশিল্পকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রবন্ধ বা আলোচনার মধ্যেও নিজস্ব লিখনশিল্পের কারুকার্যতার প্রয়োগ করা শুরু করেছেন। এতে কোনো সমস্যাই নেই যেটা হয় সেটি হল, এই নতুন গদ্যভাষ্য থেকে লেখক নিজেকে আবিষ্কার করছেন যে, তিনি কতটা নিজেকে প্রসারিত করতে পারছেন ক্রমাগত তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত স্পেসে দাঁড়িয়ে নিজেরই শিল্পকৌশলকে। এটা আমি নিজেও ইদানীং করে থাকি। আরও বলতে গেলে এরকম কাজ স্বয়ং হাইডেগারও করে গেছেন, তাঁর ‘Poetry, Language, Thought’ বইতে। যে-বই শুরুই হচ্ছে, একজন চিন্তকের কবিতা দিয়ে যা কোনোভাবেই শুধু কবিতা হিসেবে গ্রহণ করলে চলবে না। সেই কবিতাগুলোই এই বইয়ের সুচারু প্রবেশিকা বলা যেতে পারে কিংবা একটি পথ যার ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে একজন আলোচকের রাজনীতি বলি বা ডিসকোর্স স্পষ্ট হতে থাকে। যেমন বাসরঘরে ফুলের আয়োজন সুগন্ধির আয়োজন। 

আপাতত এখন এই পর্যন্তই বলব। পরবর্তীতে আরও সময় এগোলে নানা মুহূর্তে আমার উপলব্ধির কথা বলব এই বিষয়ে। বরং আরও বলার থাকলেও আমি এই আলোচনার রাজনীতি রক্ষার্থে এখানেই থামব। আবার কোনোদিন আরেকরকম ডিসকোর্স থেকে এই লেখা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।    


2 comments:

  1. খুব সুন্দর আলোচনা। সমালোচনা আর আলোচনার পার্থক্য অনেকেই আলাদা করতে পারেন না। ধন্যবাদ শতানীক।

    ReplyDelete