Wednesday 23 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। সৌমেন চট্টোপাধ্যায়



কুম্ভীলকবৃত্তি-অবচেতন মনের অজুহাত


একবার এক রাজা একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। তিনি দু'জনকে দুটি পাখি দিয়ে বললেন পাখি দুটিকে  মেরে রাজসভায় আনতে হবে দ্রুত। যে আগে আনবে তাকে তিনি পুরস্কার দেবেন পাখি মারবার একটিই শর্ত ছিল; পাখিটি মারবার সময় কেউ যেন দেখতে না পায় কাউকে না দেখিয়ে পাখিটিকে মেরে আনতে হবে এবং কিভাবে মেরেছে তা রাজাকে জানাতে হবে পরদিন দু'জন লোক রাজসভায় এলেন রাজার লোক তাদের দু'জনকে দুটি পাখি দিয়ে বললেন, "যাও তোমাদের সময় শুরু আগামীকাল থেকে যে যত তাড়াতাড়ি পাখিটিকে মেরে আনবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।'' পরের দিন রাজসভায় প্রথম জন পাখিটিকে মৃত অবস্থায় আনলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, "কিভাবে মেরেছ?" লোকটি উত্তর দিল, "মহারাজ, আমি বাড়ি থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে এমনকি নিজের চোখ বন্ধ করে পাখিটির গলা টিপে ধরেছিলাম কিছুক্ষণ পর পাখিটি মরে গেল। তারপরেই আপনার কাছে নিয়ে এলাম'' রাজা বললেন, ''তুমিই পুরস্কার পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় জন যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ তুমি এখানে অপেক্ষা কর অথবা এখন চলে যাও আমরা খবর পাঠাব'' দ্বিতীয় লোকটি প্রায় এক বছর পর রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। উস্কোখুস্কো চুল, প্রায় পাগলের মতন অবস্থা এক মুখ দাড়ি কিন্তু পাখিটিকে সযত্নে ধরে রেখেছেপাখিটি হাতে না থাকলে কেউ চিনতেই পারত না। লোকটি রাজসভায় এসে পাখিটিকে রাজার সামনে রেখে বলল, "মহারাজ আমায় ক্ষমা করুনআমি পাখিটিকে মারতে পারিনি রাজা জিজ্ঞেস করলেন, "কেন মারতে পারনি?" লোকটি উত্তর দিল, "মহারাজ আমি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করেছিলাম, নিজের চোখ বন্ধ করেছিলাম কিন্তু পাখিটিকে মারতে পারিনিমনে হল কেউ যেন দেখছে আমি বনে গেলাম, গভীর ঘন অন্ধকারের মধ্যে পাখিটিকে মারতে গিয়ে মনে হল কেউ যেন দেখছে আমি পাখিকে নিয়ে জলের নিচে নেমে গেলাম, সেখানেও মনে হল কেউ যেন দেখছে  এমনকি পাখিটির চোখ বন্ধ করে আমি পাখিটিকে মারতে গিয়েছিলাম কিন্তু তাও মনে হয়েছিল কেউ দেখছে প্রথমে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কে দেখছে কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম সর্বশক্তিমান কেউ একজন আমার চারপাশে থেকে সব সময় লক্ষ্য রেখে চলেছেন যে আমি একটি নিরীহ পাখিকে হত্যা করতে চলেছি তাই আমি হত্যা করতে পারিনি মহারাজ! আমায় ক্ষমা করুন এবং পাখিটি ফিরিয়ে নিন!'' রাজা দ্বিতীয় লোকটিকে পুরস্কার দিলেন!

          উপরের গল্প থেকে এটুকু পরিষ্কার যে আপনি যতই ভাবুন যে আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে কোনও কাজ করে ফেলবেন আর কেউ তা জানবে না বা কেউ দেখছে না তা কিন্তু নয়। কেউ না কেউ দেখছেই! কোথাও কেউ না থাকলেও আপনি অন্তত জানেন যে আপনি একটি অন্যায় কাজ করছেন কিংবা আপনি একটি ভাল কাজ করছেন ভালো কাজ করছেন কিনা বুঝরতে না পারলেও কোনও একটি কাজ যে অন্যায়  সেটির বিচার করতে পারবেন!

          উপরের গৌরচন্দ্রিকাটা ঠিক এই কারণে করলাম যে শিল্প-সংস্কৃতির জগতে বিশেষ করে লেখালেখির জগতে এইভাবে কেউ জানবে না কেউ দেখবে না কেউ বুঝবে না মনে করে অন্যের লেখাকে নিজের লেখা বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বহুকাল থেকে চলে আসছে। অথচ লেখক বেশ ভাল করেই জানেন তিনি কি করেছেন, কার লেখা থেকে কতখানি অনুপ্রাণিত হয়েছেন বা সোজাসুজি টুকেছেন।


আজকের ইন্টারনেটের যুগে হাতের মুঠোয় বিশ্ব ও সহজলভ্য বিশ্ব সাহিত্য কিন্তু একটা সময় ছিল যখন বিশ্ব সাহিত্য আমাদের সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে ছিলবেশিরভাগ সময়েই নির্ভর করতে হত অনুবাদ সাহিত্যের ওপর দুর্বল অনুবাদ সাহিত্যের কারণে অনেকেই সেইসব সৃষ্টির সঠিক স্বাদ পাননিএই ফাঁকটুকু কাজে লাগিয়ে অনেক সাহিত্যিক নিজের লেখার উপকরণ সংগ্রহ করে নিজের লেখার মধ্যে সেই সব উপকরণ রেখে নতুন করে সৃষ্টি করেছেন বা একেবারে ঝেঁপেছেন ও খাজাস্য খাজা লেখা নামিয়েছেন  অগ্রজ লেখকদের সৃষ্টিকে আমরা কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না কিন্তু তার মানে এই নয় আগের একটি লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হবার নাম করে তার প্লট, ভাষা, কাঠামো এমনকি গল্প বা উপন্যাসের চলনটুকুও  নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব আর সেই চালাকিটি ধরে ফেলে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ আনলেই তাকে অনুপ্রেরণার গল্প শোনাব বা সাব-কনসাস মাইন্ডের কথা টেনে আনব  এভাবে কোন সৃষ্টি মর্যাদা পেতে পারে না
          এখন প্লেজিয়ারিজম বা কুম্ভীলকবৃত্তি কাকে বলব কতটুকু মিল পেলে তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা চলে এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই কিন্তু গৌরচন্দ্রিকাতে বলা ঐ পাখি হত্যার গল্পের মতই একজন লেখক নিজে বেশ ভালো করেই জানেন তিনি কার লেখা থেকে কতখানি নিয়েছেন বা কতখানি প্রকৃত অর্থেই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনেও কিছু বলার থাকে অনেক সময় নিজেও বুঝতে পারেন না যে সত্যিই তিনি অন্যের গল্প থেকে উপাদান নিয়েছেন বা চুরি করেছেন বা নিজের অজান্তেই ভাষা ও চরিত্র নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছেনতবে যতই বলি না কেন অবচেতন মনে থেকে যাওয়া আগের গল্পের পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তীতে নিজের লেখাটি এসেছে তা কিন্তু সব সময় ধোপে টিকবে না। লেখক যদি পরেও বুঝতে পারেন যে লেখাটি অন্য একটি লেখার প্রভাবে প্রভাবিত বা সরাসরি সাদা চোখে অনুপ্রেরণার চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহলে তাকে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। ঘর বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে পাখিটিকে মেরে এনে পুরস্কার জিততে চাওয়ার মত ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। বেশিরভাগ কুম্ভীলকবৃত্তির কাজ সচেতনভাবেই হয় এবং লেখক নিজে বেশ ভাল করেই জানেন বা জানতেন তিনি কোন লেখার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে কলম ধরেছেনতাই  পরবর্তীকালে ধরা পড়ে তিনি যতই  অস্বীকার করুন বা অনুপ্রেরণার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেন তা আদৌ গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়াই উচিত নয়।
          সৃষ্টি মাত্রই তা অবচেতন বা সাবকনসাস মাইন্ডের খেলা আমাদের যাবতীয় যা কিছু সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম আঁতুরঘর হল আমাদের মনের কোণে থাকা এই গুপ্ত কুঠুরি পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার থেকেই প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে আমরা  নতুন কিছু করছিআমাদের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিন্দু বিন্দু জমতে থাকে আমাদের মনের মধ্যেই। তারপর অবচেতন মনের কুঠুরি থেকে একটু একটু করে আলো তুলে নিয়ে আসা হয় এবং সৃষ্টি হয় নতুন কিছু যার অভিজ্ঞতা যত সমৃদ্ধ তার অবচেতন মনে জমে থাকা আলোও ততখানি সমৃদ্ধ এখন তিনি যদি তাকে ভাষা দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে থাকেন তার শিল্পকর্মটি হয়ে উঠবে একইসঙ্গে মৌলিক এবং নান্দনিক ও তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মূর্তপ্রতীক সে অভিজ্ঞতা ভালো-মন্দ দুই হতেই পারে কিন্তু তা একেবারেই তার নিজস্বএই অভিজ্ঞতা কখনই অন্য একজনের সঙ্গে মিলবে না। একই ঘটনাকে দু'জন ব্যক্তি দু'ভাবে দেখবেন। কারণ দু'জনের চিন্তা ভাবনার মৌলিক জায়গায় পার্থক্য আছে। দু'জনের গ্রহণ করার ক্ষমতা বা  রিসেপ্টর পাওয়ারও ভিন্ন এবং তাকে প্রকাশ করার মধ্যেও ভিন্নতা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই দু'জনের লেখার মধ্যেও সে ভিন্নতা চোখে পড়বেই। দুটি একই ঘটনা অথচ তাদের প্রকাশ পৃথক ও মৌলিক। এইবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে তাহলে কী লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না থাকলে সেই লেখায় মৌলিকত্ব আসবে না? তাহলে তো জেল বন্দী কারোর কথা লিখতে গেলে লেখককেও জেলে থাকতে হয় বা ভূতের গল্প লিখতে গেলে ভূতের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এখানেই তো লেখক তার কল্পনা ও ভাবনার জাদু মিশিয়ে নিজস্ব ভিয়েনে তৈরি করেন এক কাল্পনিক জগৎ আর মজার ব্যাপার হলে এই কাল্পনিক জগতেও লেখকের অভিজ্ঞতার ছাপটাই ফুটে ওঠে। ভূতের গল্পে ভূত ব্যতীত সকলেই তো এই পার্থিব জগতের। তাই লেখার জন্য লেখককে নিজের ভাবনা ঘরেই উঁকি দিতে হয় আর সেই ভাবনার ঘরেই বন্দি থাকে নিজের অর্জিত সঞ্চয়এই ভাবনা একেবারেই নিজের। লেখক সেই বিপুল স্তর মন্থন করে তুলে আনেন লেখার অমৃতরাশি। শুধু চোখে দেখলেই যে অভিজ্ঞতা হয় তা তো নয়। ভাবনা কল্পনা শক্তি ও পূর্ব-পাঠ থেকেও সঞ্চয়ের ঘর ভরে ওঠে। এখন লেখককে লেখার সময় সচেতন থাকতে হবে যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কল্পনা আর পূর্ব-পাঠ মিলে যে জগত তাঁর নিজের ভিতরে গড়ে উঠেছে তা যেন কখনও আগের লেখার হুবুহু কপি বা রিফ্লেক্টেড কপি বা অনুসৃত লেখা না হয়ে ওঠে। আর এই কাজটি তাকে সচেতন ভাবেই করতে হবে। অবচেতনে জমে থাকা আপনার পূর্বের পাঠ আপনার কলমে নেমে আসতে পারে এই অংশটিকে ঢাল  করে অনেকে কুম্ভীলকবৃত্তির সপক্ষে অনেক যুক্তি সাজান কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল নয় যে কোন গল্পের ছাপ আপনার লেখার মধ্যে এসে ধরা দেবে অথচ আপনি নিজেই জানতে পারবেন না যে কোন লেখার প্রথম পাঠক লেখক নিজেইতাই সবার আগে লেখক নিজেই বুঝতে পারবেন লেখাটি কতখানি মৌলিকত্ব পেল।
          সাহিত্য ক্ষেত্রে আর নতুন করে লেখার মতন কিছুই অবশিষ্ট নেই ধরে নিয়েও একজন লেখক কিন্তু নতুন সৃষ্টির উদ্দেশে কলম ধরেন নিজের স্টাইলে গল্পের প্লট বিন্যাস করেন, চরিত্র সৃষ্টি করেন বা  কবিতার ক্ষেত্রে শব্দচয়ন করেন এবং এই সব কারণেই কবিতাটি বা গল্পটি বা উপন্যাসটিকে চিনে নেওয়া যায় যদি তার মধ্যে নতুনত্ব  ও মৌলিকত্বের সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে।
          সূর্য প্রতিদিন ওঠে, প্রতিদিন অস্ত যায় একই সূর্য আমরা রোজ দেখি কিন্তু তবুও প্রতিটি দিনই নতুন কারণ তার মধ্যে এমন কিছু নতুনত্ব আছে যা তাকে আগের দিনের থেকে অন্য রকম করে তোলে
          মূল রামায়ণের পাশাপাশি প্রচলিত ও অপ্রচলিত রামায়ণ হিসেবে আমরা অনেকগুলি ভাগ পাই রাম-রাবণ-সীতার কাহিনী সেই সব কাহিনি দেশ-কাল লোকাচার মেনে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কখনই এমন দাবি করা যাবে না যে একটি রামায়ণের গল্প থেকে আরেকটি রামায়ণের গল্প টুকে নেওয়া হয়েছেঅথচ দু'একটা জায়গা ছাড়া মূল গল্প প্রায় এক। বৈশিষ্ট্যে ও স্বাতন্ত্র্যে একেকটি একেক রকম হয়ে উঠেছে মুখোমুখি চলে আসা কিংবদন্তির গল্প যুগে যুগে পাল্টেছে মানুষ তার সমাজ, তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা,  তার ভাবনা সমস্ত কিছু মিশিয়ে এই সব গল্পে নতুনত্ব এনেছে কিন্তু এগুলিকে কখনই কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যাবে না
          মানুষের হাত পা চোখ কান নাক মুখ আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও একে অপরের থেকে আলাদা এমনকি যমজ ভাই-বোনদের মধ্যেও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে যা থেকে তাদেরকে আলাদা করা যায় কিন্তু যে লেখায় অন্যের লেখার হুবহু ছাপ স্পষ্ট দৃশ্যমান তাকে চুরি বলাটাই শ্রেয় অনুকরণ অনুসরণ সাবকনসাস মাইন্ড অ্যালিউশন এইসব তথ্য ও তত্ত্ব এনে চুরির অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে নিজের সপক্ষে অনেক যুক্তি খাড়া করা যায় ঠিকই কিন্তু আদতে সেগুলো ধোপে টেকে না। রূপকথা, প্রেম-বিরহ-মৃত্যু, পরকীয়া-গুপ্ত হত্যা বা রহস্য খুন, উদ্বাস্তু সমস্যা, যুদ্ধ, দেশভাগ রাজনীতি এইরকম হাজারো বিষয় নিয়ে প্রতিটি দেশেই হাজার হাজার গল্প লেখা হয়ে গেছে। তাহলে কি আর কেউ এই  সব বিষয় নিয়ে কিছু লিখবেন না? নাকি লিখলেও তাকে দাগিয়ে দেওয়া হবে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে? না, এর পরেও এই সব বিষয়ে লেখা হবে। পাঠক ভালবেসে পড়বেন এবং পড়ার ফাঁকেই বুঝে নেবে কোন লেখার মধ্যে লেখকের মৌলিকত্ব ও নিজস্বতার ছাপ আছে আর কোন  লেখাটি আগেকার লেখার অক্ষম অনুকরণ।
          কুম্ভীলকবৃত্তি সাধারণত চার প্রকারের। একেবারে সোজাসুজি চোখ কান বন্ধ করে অপরিচিত কোনও লেখকের লেখা নিজের নামে চালানো, আংশিক ও প্রয়োজন মতো অন্যের লেখা নিয়ে লেখকের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যাওয়া ও তার ঋণ স্বীকার না করে নিজের নামেই চালিয়ে দেওয়া। অবচেতন মনের থেকে সচেতন(!) ভাবে তুলে আনা ও সত্যিই প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ও কেউ জানবে না সেই সাহসে ভর করে দ্রুত খ্যাতি পাওয়ার আশায় দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে টুকে দিয়ে অ্যালিউশনের গল্প ফাঁদা।        এই অ্যালিউশন তত্ত্বটি বড় মজার। কোন ধরণের লেখাকে অ্যালিউশন বলা হবে সেই নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার জায়গা আছে। সমসাময়িক অন্য কোনও লেখকের লেখাকে তুলে আনলে তাকে কখনও  অ্যালিউশনের মর্যাদা দেওয়া যায় না। এমনকী অগ্রজ লেখকের লেখা মাত্রই তা অ্যালিউশন এবং তাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার লাইসেন্স মিলে যাবে এই ধারণাও ভুলসম-সাময়িক বা অগ্রজ ও লেখকের যে কোন লেখাকে কোন লেখক যদি ব্যবহার করতে চান তাহলে সেই লেখাটির উৎস বলে দেওয়া উচিত অথবা উদ্ধৃতি চিহ্ন দেওয়া উচিতকবিতার ক্ষেত্রে ইটালিকসে লিখেও আলাদা করে দেওয়া উচিত। যদি প্যারোডি বা স্যাটায়ারের উদ্দ্যেশ্যে লেখা হয় তাহলে  সেক্ষেত্রে লিটারেরি লাইসেন্স মিলতে পারে কারণ লেখাটি পড়লেই চিনে নেওয়া যাবে যে এটি মূল লেখার প্যারোডিআর এই সব ক্ষেত্রে মূল লেখাটির শব্দ বা ভাব ভাষাগত মিল থাকলেও প্রেজেন্টেশনের উদ্দেশ্য যেহেতু প্যারডি তাই এটিকে কখনও কুম্ভীলকবৃত্তি বলা হয় না। কিন্তু স্যাটায়ার বা প্যারডি ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে সম-সাময়িক বা অগ্রজ লেখকের লেখা নিজের লেখাতে চুপচাপ নিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব এবং কেউ না ধরতে পারলে দিব্যি উতরে গেল আর ধরতে পারলেই অ্যালিউশনের গল্প আনব এমন ভাবের ঘরে চুরি করে বেশিদিন চলতে পারে না। এখানে অনুপ্রেরণার গল্পও চলে না।


শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ Holinshed's Chronicle of England, Scotland and Ireland থেকে নেওয়া হলেও তা শেক্সপীয়ারের নিজস্ব সৃষ্টি। ম্যাকবেথের মানসিক দ্বন্দের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নাটকে তা কোনও ক্রনিক্যালে লেখা থাকে না। মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণের ঘটনার উপর দাঁড়িয়ে থেকেও স্বকীয়তায় ভাস্বর এমনকী মেঘনাদবধ কাব্যের প্যারডি লেখেন জগবন্ধু ভদ্র তার ছুছুন্দরীবধ কাব্যে। প্যারোডি হিসেবে ছুছুন্দরীবধ কাব্যও মৌলিকতায় উজ্জ্বল। মধুসূদন দত্ত নিজে এই প্যারডির প্রশংসা করেছিলেন। আপনি বলতেই পারেন জীবনানন্দ বনলতা সেন লিখতে গিয়ে এডগার অ্যালান পো'র 'টু হেলেন' ও কীটসের 'On First Looking into Chapman's Homer' থেকে কপি করেছেন এবং বড় কবি বলে অনুপ্রেরণা বলে পাশ কাটিয়ে দিচ্ছেন। কে কার থেকে টুকেছেন বা কে কতখানি বড় লেখক বা অপরিচিত নগন্য লেখক এগুলো কখনই কুম্ভীলকবৃত্তির বিচারের মাপকাঠি নয়। জীবনানন্দ যদি এই কবিতা থেকে অক্ষম অনুবাদ বা দুর্বল অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখতেন তাহলে কখনই 'পাখির নীরের মতো চোখ তুলে নাটরের বনলতা সেন' লিখতে পারতেন না। কারণ তখন তিনি নিজেই বুঝতে পারতেন অনুকরণ করতে গিয়ে আসলে তিনি কবিতার পাখিটিকে সজ্ঞানে হত্যা করছেন। তিনি বনলতা সেন কবিতায় যে প্রকাশ ভঙ্গির ছাপ রেখেছেন তা একেবারেই তার নিজস্ব। কয়েকটি লাইন মিলে গেলেই যেমন তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যায় না তেমনি শুধু দু'একটি লাইন অদল-বদল করে দিলেই কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়াও যায় না
          এখন এই কুম্ভীলকবৃত্তি আটকানোর উপায় বা কতখানি মিল হলে তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যাবে এই নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য স্কেল নেই। লেখায় কমবেশি মিল থাকেই তা আগেই বলেছি। কিন্তু কত শতাংশ মিল থাকলে তাকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে বা কত শতাংশ মিল পেলে তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যেতে পারে তার একটা প্যারামিটার ঠিক করা দরকার। ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রে বা ইংরেজি ভাষায় যা কিছু লেখালেখি হয় তার জন্য কিন্তু প্লেজিয়ারিজম চেকারের সাহায্য নিয়ে একটি লেখাতে কত শতাংশ মিল আছে, কত শতাংশ তা প্লেজিয়ারিজমের আওতাভুক্ত তা আপনি নিজেই অনলাইনে চেক করে নিতে পারবেন। অবশ্য সেখানেও যে সব লেখার ক্ষেত্রে তা জানা যাবে বা একশো শতাংস সঠিক তথ্য মিলবে এমন নয়। কিন্তু তবুও একটা চেষ্টা আছে। একেবারে অখ্যাত লেখকের অপরিচিত লেখা যদি না হয় তাহলে তা জানার উপায় আছে। কিন্তু আমাদের এখানে বিখ্যাত লেখকের বা কবির লাইন হুবুহু বা একটু অদল-বদল করে চুরি হচ্ছে। সব লেখার খোঁজ মিলছে না। যেগুলোর খোঁজ মিলছে সেগুলি নিয়ে বলতে গেলেই একদল বলছেন হ্যাঁ এটা চুরি আর একদল বলছেন না এটা চুরি নয়। তাই একটি সর্বজনগ্রাহ্য ডাটাবেস থাকা দরকার এবং একটি অনলাইন চেকিং ব্যবস্থা ও প্যারামিটার যা একেবারে নিরপেক্ষ ভাবে সফটওয়ার নিয়ন্ত্রিত মতামত দেবে। সেই মতামতের ভিত্তিতে যে লেখকের বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ প্রমাণ হবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন যেমন অনেকে নামী পত্রিকা বা প্রকাশনা গোষ্ঠীর ছায়ায় থেকে রেহাই পাচ্ছেন বা নামী পত্রিকার সম্পাদক হয়েও নিশ্চিন্তে নিজেই চুরি করছেন এবং  তার বা তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে লেখা ছাপা হবে না ইত্যাদি ভয় পেয়ে চুপ করে যাচ্ছেন তখন আর এই বিষয়টা থাকবে না। যা বলবে ঐ সফটওয়ার বলবে এবং যা সিধান্ত নেবে তা ঐ "কুম্ভীলকবৃত্তি নিবারণ সমিতি" ঠিক করবে। এখন এই ধরণের সফটওয়ার তৈরি করা কতখানি সম্ভব ও তার দায়িত্ব কারা কারা নেবে এটাই মূল প্রশ্ন এবং এ বঙ্গ দেশে সরষের তেলের যেমন দাম তেমনই ' Sourceএ-র ভিতরে ভূত'(এই কথাটি একটি বিখ্যাত কাগজের একটি দেওয়াল লিখন থেকে নেওয়া। প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগের আগেই স্বীকার করলাম।হাসির ইমোজি কল্পনা করুন) থাকবে না এ কথা জোর গলায় বলতে পারি না। তাই গৌরচন্দ্রিকায় বলা গল্পের অংশ উল্লেখ করেই এই লেখা শেষ করছি একজন লেখক নিজে খুব স্পষ্টভাবেই জানেন তিনি কতখানি অনুসরণ করলেন আর কতখানি নিজের অভিজ্ঞতা ও ভাষা ব্যবহার করে একটি নিজস্ব শিল্প সৃষ্টি করলেন

শেষে এই অংশটিও রইল ...
ART AS IMITATION AND REPRESENTATION
BY
ENYIMBA MADUKA


"The point being made is that the term “imitation” connotes “re-presentation”, “re-creation”. It does not imply copying, mimicking or making a counterfeit of anything whatsoever. Hence, we employed the concept of imitation and representation interchangeably to portray the nature, features and role of art. Art is therefore essentially an imitation or representation of reality. In representing reality, the artist’s presents structures and harmonies in a much broader context than mere self-expression. Art is decentralized, dispersed, and given to all in the form of a certain focus of attention, brought to bear on the world as it is. Thus a work of art (visual, audio or literary) can modify one’s view of the world by strengthening or weakening one’s sense of the propriety or the value of certain very general attitudes. For instance, an attitude of openness to mystery, or of openness only to the clearly-defined, clearly lit andcomprehensible.We therefore conclude that as imitation and representation, artpartly determines one’s view of nature or reality and also one’s sense of self. Following this, we agree with Richard Sheursterman that:
                                                                      The gap Plato maliciously posited between art and reality has become an unquestioned                                                                                dogma… But, in an obvious way, the idea of this gap is quite simply false. Art is undeniably                                                                                real, it exists concretely and vividly in our world and in our lives,…of course, we can always                                                                     between a real object and it's artistic representation, but this does not entail that the                                                                             representation is either unreal or intrinsically deceptive (52).''





1 comment:

  1. বেশ লাগলো। আসলে ছোট্টবেলা থেকেই মুখস্থ করে হুবহু উত্তর লেখার অভ্যেস আর শিখতে দেয় না হয়তোবা, বিষয় হৃদয়ঙ্গম হলেই লেখা আপনিই আসে। নিজের লেখাটি নিজেই লেখা, এ একটি অভ্যাস, ছাত্রাবস্থায় শেখার। কিন্তু তা আর শেখা হয় কই?

    ReplyDelete