আশ্রয়কেন্দ্রে
যাহারা জড়ো হইয়াছে
কে সেই দর্শক?
বিশৃঙ্খলার এই সৌন্দর্য দেখিতেছে কে? এই যে সূত্রহীনভাবে কেবলই ছড়াইয়া-পড়ার
রোমাঞ্চ, রোমাঞ্চ না কি রুদ্ধশ্বাস ছুট! কোনও দিকে কোনও বিকল্প দুয়ার কি খুলা আছে?
না-ই যদি রহে, তবে এই ছড়াইয়া-পড়া এক বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর কী! তাহাকে নাহয় আনন্দের
সহিত মানিয়া লওয়া গেল। কিন্তু সেই উল্লাসের ভিতরে ভিতরে এইভাবে গুম-মারিয়া থাকাটির
শানেনজুল কী? তবে কি ভিতরে ভিতরে
উৎসারণ-বিন্দুর তরে একটি হানটান রহিয়া গিয়াছে! যদি থাকে, তাহা স্বীকার করিলেই হয়।
ইহাতে চক্ষুলজ্জার কী আছে! কী এমন গড়িয়া-তুলা তত্ত্ব ভাঙিয়া পড়িবে তাহাতে? পড়েই
যদি, তাহাতেই বা ক্ষতি কাহার? তত্ত্বের দিকে তাকাইয়া কি ঘড়ি মিলাইবার মতো কেবলই
কাঁটা আগুপিছু করিয়া ভ্রম শুধরানোয় কাটিবে সময়! প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসিয়া হাজির।
পথের পর পথ। এত যে পথিকতা, পথিকও কি বহু? তাহা হইলে ছড়াইয়া পড়িতেছে কে ...
...
জমাট-বাঁধা মেঘটি তো
খাসা দেখাইতেছে। কিন্তু ছাতার মাথাটি দিয়া একটি গোঁত্তা লাগাইলেই ঝুরঝুর করিয়া ঝরিয়া
পড়িবে না তো? জলবৃষ্টি কিছু নাই। খানিক বাতাস আর খানিক ঘেঁসের গুঁড়া। এইই হইল
আত্মদর্শনের বিপদ। অথচ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করিবার ওই একটি মাত্রই তো সম্বল। ভাঙা
হউক চোরা হউক, ওই সামান্য নৌকাখানি লইয়াই সাত সমুদ্দুর তেরো নদী। কথার ছলে কথা
উঠে, ঢেউয়ের ছলে ঢেউ। সামাল সামাল করিয়া বাহিয়া চলেন যিনি, তাঁহারও বসত এইখানে।
দাওয়ায় বসিয়া চুপচাপ উদাস নয়নে যখন তিনি হুক্কা খান, তাঁহাকে অচিন লাগে। গাছের টঙে
চড়িয়া বকফুল হইতে আলো নেয় রৌদ্র। নারিকেল পাতার ঝিলমিল হইতে দোল খায় বাতাস। তিনি
দর্শক। তিনিই দৃশ্যের রচয়িতা। কৃষক যেমন, অন্ন ঘনাইয়া তুলে নিজ হাতে। নিজেও খায়
গোগ্রাসে ...
...
সম্ভাবনার কথা কে বলিতে
পারে! হয়তো শূন্য গহ্বর মাত্র। বদ হাওয়া। মিথেনের ঝাঁজ। ক্ষণিক আলো আর আগুনের কারসাজি
জাগাইবার আগেই শ্বাসরোধে মৃত্যু। হয়তো। হয়তো নয়। হয়তো চাপা-পড়া ইতিহাস কিছু।
স্মৃতি। কোন্ অতলে তলাইয়া-যাওয়া ছায়াছবির খানিক। বা, একেবারেই দরোজা-না-খোলা কোনও
কামরা। আসন্নের জাদুঘর। গ্রহান্তরের লিপি। মায়া ও করুণায়-ভরা আঁখিপল্লব। অজানা
ভাষার পাঠ। পদে পদে ভুল করিতে করিতে হাসা। অন্বয় গড়বড়াইয়া হাসা। হাসিতে হাসিতে
ফাঁসিতে ঝুলিবার আমন্ত্রণ। এদিকেও মৃত্যু তবে! হুম, তাহাই। তবে অপমৃত্যু নয়। গাছের
মৃত্যুর পর কোথাও বীজের স্বপ্ন থাকিয়া যায়। কাহার যেন উক্তি! উক্তি যাহারই হউক,
কথা হইতেছিল সম্ভাবনা লইয়া। ঢাকনা খুলিয়া খুলিয়া দেখিয়া যাইতে হইবে, কী আছে সারি
সারি কলসির ভিতর। ভৌতিক কর্ম বটে ...
...
সত্যের জয় হইবে, ইহা
হইতে বড় মিথ্যা আর কিছুই হইতে পারে না। বারবার হারিয়া সে ধুলায় লুটাইয়া পড়ে। করুণ,
অবমানিত, ধুলামাখা তাহার মূর্তিখানি সূর্যাস্তের আলোয় ধকধক করে। কষের রক্ত মুছিয়া
আবার সে উঠিয়া দাঁড়ায়। সে বোঝে, নিজেকে উপস্থাপিত করিবার ধরন বদলাইতে হইবে।
বদলাইতে হইবে ভাষা। অরণ্যের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে, জনপদের ভিতর দিয়া হাঁটিতে
হাঁটিতে, নদীর পাড় ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে, বালি ও বরফের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে
– সেও কি একটু একটু করিয়া বদলাইয়া যায় না? মিথ্যা নানা ভেক ধরিতে পারে, কিন্তু
তাহার কোনও বদল নাই। সত্য বদলায়। প্রতিটি পরাজয়ের ধূলি শরীরে মাখিয়া, সত্য কেবলই
আরও সত্য হইয়া উঠে। ...
...
যে-বাজনাটি আর বাজে না,
তাহা আছাড় মারিয়া ভাঙিয়া ফেলিলেই হয়। মৃতদেহ আগলাইয়া বসিয়া থাকিয়া কী লাভ! সময় মতো
সৎকার না-করিলে দুর্গন্ধ ছড়াইবে। এই কথার ভিতর কোনও নিষ্ঠুরতা নাই। গাছ হইতে শুকনা
পাতাটি যে অবলীলায় ঝরিয়া পড়িয়া যায়, তাহাই স্বাভাবিকতা। নহিলে নতুন পাতা গজাইবে কীভাবে? কিন্তু একদিন গাছকেও মরণদশায় ধরে। তখন পাতা
শুধু ঝরিতেই থাকে। ঝরিতে ঝরিতে নেড়া ডালপালাগুলি পড়িয়া থাকে শুধু। তাহারাও শুকাইয়া
যায় একদিন। বুঝা যায়, গাছের ভিতর রক্ত চলাচল বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তখন কুড়াল দিয়া
কাটিয়া জ্বালানি বানানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। কাঠ তেমন তেমন হইলে, আসবাবও বানানো
যায় দু-একটি। গাছের সমস্ত হিল্লোল স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়া থাকে সেই আসবাবের ভিতরে।
সমস্ত সংগীত আজ স্তব্ধ। শুকনা মড়মড়ে স্বরলিপির পৃষ্ঠার উপর ঝালমুড়ি খাইতেছে লোকে ...
...
কোনও কোনও দিন ঘুড়ি
বহুদূর চলিয়া যায়। নিচু হইতে বিন্দুবৎ দেখায় তাহাকে। যেন আকাশের বুকে নিশ্চল একটি
চিল। পৃথিবীর সহিত তাহার কোনও যোগ নাই। ছাদের উপর লাটাই হাতে সুতা ছাড়িয়া যিনি
শূন্যপানে তাকাইয়া আছেন, তাঁহার চোখেমুখে মুগ্ধতা। এই যে এত উঁচুতে পৌঁছাইয়া গেল
ঘুড়িটি, এ কি বাতাসের কারিগরি? না কি ঘুড়িটিই কোনও জাদু জানে! একবার লাজুক লাজুক
ভাবে নিজের কৃতিত্বের কথাও মনে হয় তাঁহার। আবার ভাবেন – ধুস, ঘুড়ি তো আমি রোজই
উড়াই, কই এমন তো হয় না। ভাবিয়া, আবার মুগ্ধ চোখে উপর পানে তাকান। ঘুড়ি কাটিয়া
গেলেও তাঁহার কোনও দুঃখ নাই আজ। ভাসিতে ভাসিতে তাহা চলিয়া যাইবে কোন্ অজানা
মহল্লায়। কোন্ অজানা মানুষের হাতে গিয়া পড়িবে। তাহাকে তিনি চিনেন না। অথচ তাহার
কাছেই মনে মনে পৌঁছাইতে চান। মনে মনে তাই ঘুড়ির বুকে লিখিয়া রাখেন তাঁহার গোপন
কথাগুলি। একদিন না একদিন কেহ নিশ্চয়ই সেসব ধরিতে পারিবে। ভাবিতে ভাবিতে লাটাই হইতে
আরও সুতা ছাড়িতে থাকেন তিনি ...
...
বাড়িটিতে কি কেহ আছে?
এ-কামরা সে-কামরায় উঁকিঝুঁকি মারিয়া টের পাওয়া গেল কিছু? কেহ যদি নাইই, ফাঁকা
বাড়িতে এইভাবে হাঁচাবাঁচা করাটা কিন্তু দৃষ্টিকটু। আবার এমনও তো হইতে পারে, মানুষ ভিতরে অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে, তাই সাড়া
দিতেছে না। তেমন হইলে আবার দায়িত্ব বাড়িয়া যায়। এমনিতে, কাহাকেও না-পাইয়া নিঃশব্দে
কাটিয়া পড়া যাইত।
যে-সম্ভাবনাটির কথা উঠিল, তাহাতে অন্তত খানিক প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা তো
করিতেই হয়। কিন্তু কে কী করিবে? এখানে ডাক্তার বদ্যিই বা কোথায়! চুপি চুপি বলা
যাক, অত দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আসল কথাটি ভিন্ন। কোনও সাড়া যে মিলিতেছে না, ভিতরে
আসলেই মানুষ নাই। থাকিবে কেমনে? ভিতরের মানুষটি আজ মশকরা করিয়া নিজেই অতিথি সাজিয়া
আসিয়াছে। আর এ-ঘর ও-ঘর উঁকি মারিয়া দেখিতেছে, ভিতরে কেউ আছে কি না! ঘটনাকে এইখানে
ছাড়িয়া আমরা বিদায় লইতে পারি। ইতিমধ্যে বুঝি অতিথিকে দরোজা খুলিয়া দিয়াছে বাড়ির
মালিক। চা-নাস্তা খাইতে খাইতে ধুম আড্ডা জমাইয়াছে তাহারা ...
...
বাতাসে দেশি রাগের একটি
আভা ঝরিয়া পড়িতেছে। কিশোরেরা কাশের গুচ্ছ বাঁধিয়া আনিয়াছে। কিশোরীরা গাঁথিয়াছে
শেফালি মালা। নবীন ধানের মঞ্জরীও ডালায় চমৎকার মানাইয়াছে। কাশের গুচ্ছের ভিতর
কয়েকটি রঙিন পালকও গুঁজিয়া দেওয়া যায়। কিন্তু সেখানে যদি রাখা যায় সাপের খোলস বা
প্যাঁচানো বৈদ্যুতিক তার? শেফালির মালা না হয় না-গাঁথিলেও চলে। একটি রেকাবির উপর
সাজাইয়া দেওয়া যায় নানা রঙের নানা রকম ফুল। কিন্তু যদি ফুলের ভিতর মিশিয়া যায়
জ্বলন্ত কাঠকয়লার টুকরা? বা, তুঁতে হিরাকষ গন্ধক? ধানের মঞ্জরীর আড়ালে সেনাবাহিনির
দাগড়া দাগড়া পোশাক? কী আর হইবে – দেশি রাগের আলাপটি ছিন্নভিন্ন হইয়া মাটিতে মুখ
থুবড়াইয়া পড়িবে। ও আমার দেশের মাটি, ঝুঁকি লওয়া ছাড়া যে আর উপায় নাই। বাহিরে তুমুল
বৃষ্টি। ধ্বস নামিয়া পুরাতন রাস্তা সব মিশমার হইয়া গিয়াছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাহারা
জড়ো হইয়াছে, কেহ কাহাকে চিনে না। কিন্তু কথাবার্তা বন্ধ নাই। দেখিতে দেখিতে
দুই-একটি প্রণয়ের টুকরাও ঘনাইয়া উঠিতেছে ...
অসাধারণ !বারবার পড়ব ।
ReplyDelete