Wednesday 23 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। সোনালী চক্রবর্তী



বিষাদ রচনার অনুবাদের প্রতি অধিক আসক্তির ব্যক্তিগত কিছু অজুহাত 

সাহিত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিষাদ ভাবনা বিষয়ে ভাবতে বসলে প্রথমেই আসে শিকড়ের খোঁজ। বিষাদের উৎস যদি ধরি গ্রীক 'melancholia', তাহলে এক বিচিত্র পরিস্থিতি আসে। মধ্যযুগীয় চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী যদি মেনে নিতে হয় যে রক্ত, কফ, কালো আর হলুদ পিত্তের মধ্যে যাদের শরীরে তৃতীয় উপাদানটির ক্ষরণ ও প্রাধান্য বেশী, তারাই বিষাদগ্রস্ত আর মনন, ভাবনা, চিন্তা ও শরীরে যে প্রভাব বহমান, তারই পরিণতি হলো তাঁদের বিষাদ লেখনী, তাহলে সেক্ষেত্রে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের ব্যবধান আসতে পারে না। 'বিষাদ' কোনও গোলার্ধ নির্ভর নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমরা পাশ্চাত্যে যেভাবে বিষাদ ভাবনার লেখক হিসাবে কাউকে নির্দিষ্ট করতে এগোচ্ছি বা চাইছি ঠিক সেভাবে প্রাচ্যে তা পারছি না। এর কারণ বহু জটিল ও বিবিধ। মোটামুটি আমার ধারণা যা বলে তাতে পাশ্চাত্যে সাহিত্য ধারার শ্রেণীবিভাগ প্রাচ্যে বিপরীত নীতির উপর গঠিত। শুধু কবিতাকেই যদি ধরি, পাশ্চাত্যে যেভাবে সনেট, কনফেশনাল, ন্যারেটিভ, আকরোস্টিক , লিমেরিক ইত্যাদি ভাগে কবিতার শ্রেণীবিভাগ করা হয়, আবার প্রি- র‌্যাফেলাইট, মেটাফিসিক্যাল ইত্যাদি specialisation, এবং এক একটি literary group এর পত্তন ও ধারার প্রচলন, প্রাচ্যে কিন্তু এই ঘটনা খুবই বিরল। এখানে এক একজন বিশিষ্ট কবিকে মূল ধরে তার লেখন পদ্ধতি অনুযায়ী ঘরানা আরোপের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন রাবীন্দ্রিক, জীবনানন্দীয় ইত্যাদি। ব্যতিক্রমও আছে।
সুতরাং বিষাদ ভাবনা নিয়েও একইভাবে আমি বলবো, পাশ্চাত্যে যেভাবে অন্ততঃ কয়েকটি নাম আমরা নিতে সক্ষম, প্রাচ্যে সেভাবে নির্দিষ্ট করে কারও নাম নেওয়া সম্ভব নয়। 'বিষাদ' কোন কষ্টার্জিত অনুভব নয়, লেখনীর ক্ষেত্রে intentionally applied art ও নয়। বিষাদের বশবর্তী হয়ে যারা লিখেছেন বা লিখতে বাধ্য হয়েছেন তাদের মধ্যে শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকটি নামই অতি উজ্জ্বল হয়ে থেকে গেছে কারণ তাদের সৃষ্টিরা বিষাদ সংজ্ঞার গণ্ডী উত্তীর্ণ হয়ে প্রকৃত সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছে। উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যায় সিলভিয়া প্লাথ, টেনিস উইলিয়ামস, মার্ক টোয়েন, স্কট ফিটজেরাল্ড, আরনেস্ট হেমিংওয়ে, হারুকি মুরাকামি, কাজুও ঈশিগুরো আর বিস্ময়কর হলেও জে কে রাউলিং প্রমুখের নাম।
পরবর্তী প্রশ্ন যেটা আসতেই পারে সেটি হলো কাউকে কি শুধুই 'বিষাদের কবি' বলা যায় বা এরকম নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ কোনও কবিকে করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? সেক্ষেত্রে এটুকুই বলার 'বিষাদ' আর 'কবি' - এই দুই শব্দের পারস্পরিক অন্তরঙ্গতা এত বেশী কী করে নির্দিষ্ট কিছু জনকে 'বিষাদের কবি' হিসাবে চিহ্নিতকরণ সম্ভব আমি প্রকৃতই জানি না। বিষাদহীন কোন কবিকে পড়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, কোন ক্রমেই আমার ঘটেনি। বিষাদ যেন কবিজন্মের অন্তর্লীন এক মাত্রা যাকে অতিক্রম করা তো দূর, সজ্ঞানে আগলে রাখতে চেয়েছেন এমন কবিও খুব বিরল নয়। দ্রোহ, প্রেম, বিপ্লব এভাবে যেমন করে কবিতার পৃথকীকরণ সম্ভব নয় তেমনি কাউকে শুধুই বিষাদের কবি বলে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে অযৌক্তিক। 'কবিতা' হিসাবে যে রূপই আমাদের সামনে আসুক, তা উচ্ছ্বাসেরও যদি হয়, কিন্তু নির্মাণকালে তার জারণ যখন কবি মানসে চলছিলো সেই সময়ের একাকিত্ব ও বিষাদকে আমরা কী করে উপেক্ষা করতে পারি?
'অনুবাদ' শব্দটি, আমার ধারণা, অন্যান্য আভিধানিক শব্দের তুলনায় অধিক অভিযোজিত যাকে আমরা more evaluated এভাবেও বলতে পারি। 'অনুবাদ সাহিত্যের একটি ভাগ' - এভাবেই আমাদের ধারণা গড়ে উঠেছে কারণ সাহিত্যের পাঠকরা অতি স্বাভাবিক তাড়নাতেই কখনও নিজস্ব মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধ থাকেননি বা থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের অনেক বেশী conscious হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি যে functional art আর fine art সমানুপাতে অনুবাদেরও দুটি স্তর আছে আর তারা হলো 'অনুবাদ সাহিত্য' আর 'অনূদিত সাহিত্য'। সাধারণ flat translation অর্থাৎ শুধুমাত্র ভাষান্তর করে একটি সৃষ্টিকে অন্যান্য ভাষায় পড়তে সুযোগ করে দেওয়াটাই আমাদের কাছে বহুলাংশে পরিচিত ও প্রচলিত আর একেই 'অনুবাদ সাহিত্যের একটি বড় ভাগ' এই হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু 'অনুবাদ সাহিত্য' হলো একটি fine art যে কারণে বর্তমানে translation শব্দের পরিবর্তে trans creation ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র ভাষান্তর নয়। অনুবাদ সাহিত্য সম্পূর্ণ পৃথক আঙ্গিক, পৃথক স্বত্বার এক সাহিত্য যার লেখক হলো অনুবাদক বা trans creator আর তার পাঠকও ভিন্ন। জাক দেরিদার "What is a Relevant Translation ?" প্রবন্ধটিকে বাংলায় trans create করতে বসে আমি মূলত এই কথাটিরই বিশদ ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম । অনুবাদের সঙ্গে আমার যে সাহচর্য তৈরী হয়েছিলো আকস্মিকভাবেই , এর ব্যাখ্যা পাওয়ার পর , এটি যে সম্পূর্ণ পৃথক এক শিল্প , তা জানার পর আমার এর প্রতি আকর্ষণ প্রগাঢ় হয়েছে । একটি লেখাকে তার মৌলিক উপাদান অক্ষুণ্ণ রেখে অন্য ভাষায় তার কি কি রূপ রস গন্ধ বর্ণের বিস্তার হতে পারে তা আবিষ্কারের মধ্যে যে কি অদ্ভুত উত্তেজনা আর চ্যালেঞ্জ আছে , তা অনুবাদক মাত্রেরই অভিজ্ঞতা হয় আর এই দুটি বিষয়কেই অনুবাদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত আকর্ষণের মূল কারণ হিসাবে আমি খুঁজে পাই
এই সময়ের বাংলা কবিতার অনুবাদ হচ্ছে কিন্তু তা এতো সামান্য যে অন্যান্য ভাষার অনুবাদের সঙ্গে তার কোনো তুলনাই আসতে পারে না। কারণ ঐ যে বললাম,অধিকাংশই 'অনুবাদ সাহিত্য' প্রসঙ্গে অজ্ঞাত সুতরাং তা যথার্থ গুরুত্ব পায়না। ইংরাজি সাহিত্যের মেধাবী বাঙালি ছাত্রেরা বা বিদেশী ভাষায় দক্ষ সাহিত্যবোধসম্পন্ন বাঙালিরা লেখক বা কবি হয়ে উঠতে যতটা আগ্রহী,  অনুবাদক হিসাবে তার সিকি ভাগও নয়। এ এক বিতর্কিত, কঠোর ও অপ্রিয় সত্য।
'বিষাদ'কে আমার obsession বলতে কোন দ্বিধা নেই। আমি তীব্র বিশ্বাস করি অন্ত:সলিলা ফল্গুর মতো বিষাদের বোধ বহমান না থাকলে কেউ কবি বা লেখক হতে পারে না। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন সময়ে যাদের লেখায় তা উচ্চকিত ভাবে এসেছে, সে যে আঙ্গিকেই হোক বা বিষয়ে, তা আমার গবেষণার বিষয়বস্তু। মূলত: এখান থেকেই আমি সিলভিয়া প্লাথ, এমিলি ডিকিন্সন, ভার্জিনিয়া উলফ আর এমিলি ব্রন্টির প্রেমিকা। আপাত সাধারণ একটি মানুষ কিভাবে অন্তর্গত বিষাদতাড়িত হয়ে অনিন্দ্য সাহিত্যের স্রষ্টা হয়ে ওঠেন, এই বিস্ময় আমায় প্রবল তাড়িত করে 

No comments:

Post a Comment