Wednesday 23 October 2019

বাক্‌ ১৩৮ ।। প্রদোষ পাল লিখছেন আর্টকলেজের মডেলদের নিয়ে



।। আর্টকলেজের মডেল।।

তখন আর্টকলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। একদিন আমাদের লাইফ স্টাডির শিক্ষক অশেষ বাবু (মিত্র) বললেন, 'আজ তোমাদের নতুন ধরণের 'লাইফ স্টাডি' করানো হবে।' লাইফ স্টাডি বলতে মডেলকে সামনে রেখে স্টাডি করা। পোশাক পরিয়ে বা পোশাক ছাড়া। অশেষ বাবু শেষোক্ত ব্যাপারটিই বলতে চেয়ে 'বিশেষ স্টাডি' শব্দ ব্যবহার করেছেন। মনে আছে, সেদিন লাইফ স্টাডি, বিশেষত ন্যুড স্টাডি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি নারী দেহকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফুলকে ঢেকে রাখা যেমন তার সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখা, নারীদেহের আসল সৌন্দর্য নাকি নিরাবরণে! সৌন্দর্যতত্ত্বের শিক্ষালাভের গোড়ায় যাকে স্টাডি করতে হয়। প্রথমত দেহের গঠন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্টাডি করা, দ্বিতীয়ত নারীর নিরাবরণ সৌন্দর্য সম্পর্কে জানা। সেদিন তাঁর কথায় হাঁ করে শুনেছিলুম। পরে অবশ্য মনে হয়েছে, সৌন্দর্য কি কেবল নারীদেহেই থাকে? পুরুষদেহে নয়? ক্লাসের মধ্যে আমরা যারা ছাত্র ছিলুম, তাদের নাহয় নারীদেহ নিরীক্ষণ বা স্টাডি করার বাসনা একটু বেশি থাকবে, কিন্তু ছাত্রীদের? তাদের তো উল্টোটা, মানে পুরুষদের নিরাবরণ সৌন্দর্য স্টাডি করার ইচ্ছে হতেও পারে! সে ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপারটা সমান ভাবে গুরুত্ব কেন পাবে না? নারীর বেলায় নিরাবরণ আর পুরুষের বেলায় নয় কেন? আর এসব ঠিক করবে শুধু মাত্র পুরুষরা? মডেল নিয়ে যত ঘটনা যত লেখালেখি, যত কাব্য উপন্যাস প্রায় সবই তো পুরুষ শিল্পী ও নারী মডেল নিয়ে। ব্যতিক্রম খুবই ক্ষীন। যাই হোক, তখন তো আর এ সব ভাবনা জোরালো ভাবে মনে আসেনি! ক্ষীণ ভাবনা প্রকাশেরও সাহস ছিল না।



কাঙ্ক্ষিত মডেল স্টাডির প্রথম দিন অশেষ বাবু আমদের সমস্ত ছাত্র ছাত্রীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। মডেলকে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসিয়ে তারপর ক্লাসের ভেতরে যেতে বলা। মুখ নিচু করে ক্লাসে ঢুকলুম। সামনে টুলের ওপর বসে আছে উন্মুক্ত বক্ষের এক বিগত যৌবনা নারী। হ্যাঁ, সেকেন্ড ইয়ারে ফুল ন্যুড ক্লাস হতো না। হতো হাফ ন্যুড। মানে শুধু বক্ষদেশ উন্মুক্ত। থার্ড ইয়ার থেকে শুরু হতো ফুল ন্যুড। শরীরে কোনো পোশাক থাকতো না।
ক্লাসে ঢোকার আগে মনে মনে কতকিছু ভেবেছি। আর পঁচ জনের মতো মডেল নিয়ে আমাদের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আমার কৌতুহল ছিল অসীম। আর্ট কলেজে যখন ভর্তি হইনি একজন সিনিয়র দাদার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলুম মডেলের ব্যাপার নিয়ে। সে অবলীলায় যখন বলছিল, বেশ অবাক হয়েছিলুম। তার মানে আমদেরও একদিন মডেল স্টাডি করতে হবে? উন্মুক্ত নারী দেহ দেখার কৌতুহল অনেকের মতো আমারও ছিল তা তো আর অস্বীকার করা যায়না! কিশোর বয়সের শেষ দিকে প্রাকৃতিক নিয়মেই কৌতুহল বেড়ে যায়। এই বয়সেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে নারীর বক্ষ বা উন্মুক্ত শরীর দেখার জন্য কত চঞ্চল হয়েছি এককালে! বয়সের সাথে সাথে চঞ্চলতা, ছটপটানি কমে যায়। আমারও চঞ্চলতা, ছটপটানি কমে গ্যাছে। সেই আমি যখন শুনলাম সম্পূর্ণ নিরাবরণ কোনো নারী আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমাকে স্টাডি করতে হবে, কৌতুহল উত্তেজনা হবে না? কিন্তু ক্লাসে মডেলের সামনে দাঁড়ানোর পরমুহূর্তেই সব কৌতুহল, সব উত্তেজনা নিমেষে উধাও। এটা যে কেবল মডেলদের শারিরীক গঠন ও বয়সের কারণে, তা বোধহয় নয়! পরে থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ার ও ফিফত ইয়ারে যখন ফুল ন্যুড স্টাডি করেছি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভালো শরিরী ঘঠন ও সুন্দরী মডেলরাও ছিল। ক্লাসে ঢোকার পর আমারা যেন অন্য মানুষ হয়ে যেতুম।




প্রসঙ্গত একটা ঘটনার কথা বলি। বোধহয় আমারা তখন সেকেন্ড ইয়ারে। আর্টকলেজের দাবি, ডিগ্রি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে আন্দোলন শুরু হলো। সে সময় 'পরিবর্তন' নামে একটা ম্যাগাজিন রেরতো। অনেকেই জানবেন যে কোনও বিষয়কে একটু মুখরোচক ও রসিয়ে পরিবেশন করতে পছন্দ করতো 'পরিবর্তন'। সেবার ঐ ম্যাগাজিনে কলেজের ব্যাপার নিয়ে কাভার স্টোরি সহ বিশাল করে রিপোর্ট বেরোলো। যথারীতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মডেলদের ব্যাপারটাও রসালো করে প্রকাশ করলো। আমার মনে হয় আর্টকলেজের মডেল নিয়ে জনমানষে ইতি পূর্বে কোনও ধারণা ছিল না। বিশেষকরে সাধারণ মানুষরা জানতই না। জানাটা কোনো দোষের না, যদি তা সঠিক ভাবে জানানো হয়। 'পরিবর্তন' প্রত্রিকাটি সঠিক ভাবে জানায়নি। ফলে সাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার ফলও অনেক ছাত্র ছাত্রীকে চোকাতে হয়েছে।
যাই হোক, ঘটনাটা বলি। এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়েছি। দিদি স্থানীয় একজন কথা প্রসঙ্গে মডেলদের ব্যাপারটা তুললেন। লক্ষ্য করলুম, তিনি যখন বলছিলেন আমার দিকে ঠিকমত তাকাতে পারছিলেন না। লজ্জা পাচ্ছেন তাকাতে। বললেন, 'পরিবর্তনে মডেল নিয়ে যে সব লিখেছে ওগুলো সত্যি? তোমারাও ওরকম কর?'
বললাম, 'হ্যাঁ, আমরাও মডেল দেখে স্টাডি করি, কোনও অসুবিধা তো নেই।
শুনে তাঁর মুখ চোখ যেন কেমন হয়ে গেল। তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না। মডেল দেখে স্টাডি করে এমন একজন তার সামনে বসে আছে! এবং এতো সহজভাবে ব্যাপারটাকে বলছে! তাঁর অবস্থা বুঝে যতটা সম্ভব সহজ করার চেষ্টা করলুম। বললুম, 'দেখুন বাইরে থেকে এমন ভাবনা অনেকেরই হয়, হয়তো আমি না আর্টকলেজে পড়লে আমারও হতো। বাস্তবে কিন্তু তেমনটা নয়। আমরা যখন ক্লাসে ঢুকি। হাতে পেন্সিল বা তুলি নিই তখন আমাদের কোনও বোধ কাজ করে না যে আমাদের সামনে কেউ জামকাপড় পরে বসে রয়েছে না জামাকাপড় ছাড়া বসে রয়েছে। মডেলরাও যেমন আমাদের কাছে সহজ আমরাও ওদের কাছে সহজ। আমাদের কাছে মডেলরা কেউ দিদি তুল্য, মাসী তুল্য, কেউ মা তুল্য। ওরাও কাউকে ভাই বা সন্তানের মত ভালোবাসে, স্নেহ করে। 'পরিবর্তন' পড়ে সব বিচার করতে যাবে না।'
তিনি শুনলেন, কিন্তু খুব যে সহজ হতে পেরেছেন মনে হলো না। 



আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের বেসিক ধারণা মোটামুটি এমনই। আজও প্রায় একই রয়েছ। সিনেমা, সিরিয়াল, গল্প উপন্যাসে যেভাবে শিল্পী ও মডেল নিয়ে ছেঁদো কাহিনি ফাঁদা হয় তাতেই পরিষ্কার এই শিল্প-মাধ্যম এখনও কোন গহ্বরে পড়ে রয়েছে! এখনও ঘরভাড়া নিতে যাওয়া কোনো কোনো পাড়ার অর্ধশিক্ষিতরা ছবি আঁকার পেশায় যুক্ত শিল্পীদের আপাদ মস্তক মেপে নেয়। আমতা আমতা করে জানতে চায় মডেল স্টাডি করবে কিনা! তাহলে পাড়ায় ঠাঁই হবে না। এই অর্ধ শিক্ষার অন্যতম পাথেয় সে সময়ের 'পরিবর্তন' থেকে আজকের সিনেমা, টেলিফিল্ম, সিরিয়াল। একবিংশ শতাব্দীতেও শিল্পী মানে দাঁড়ি গোঁফ। পাজামা পাঞ্জাবি ও কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। পায়ে অবশ্যই কোলাপুরি চপ্পল। আর মডেল স্টাডির নামে ন্যাকামো। মডেলের প্রেমে পড়া থেকে নানান গালগপ্পো। ইউরোপ বা উন্নততর দেশে এমন কিছু ঘটলেও আমাদের মতো শিক্ষায় ও অর্থনৈতিকভাবে পিছয়ে পড়া অনুন্নত দেশে কোনো ভাবেই এসব সম্ভব নয়।
এখনও মডেলদের নাম বদলে পেশা বদলে এই কাজ করতে হয়। বাড়িতে, পাড়ায় তাকে যে নামে জানে আর্টকলেজে অন্য নাম নথিভুক্ত হয়। ছাত্র ছাত্রীরাও তাদের অন্য নামে চেনে। পেশা গোপন করতেই হয়। ধরা যাক বাড়িতে বলতে হয় তারা কোনো ব্যাগ বা সেলাই কারখানায় কাজ করে৷ একবিংশ শতাব্দীতেও চিত্রটা একই। অভাবের কথা নতুন করে কী আর বলবো? আমরা যঝন আর্টকলেজে পড়তাম দিনপিছু মডেলরা পেত ২৫/৩০ টাকা। যখন আর্টকলেজ ছেড়ে আসি মূল্যটা বেড়ে হয়েছিল ৪০/৫০ টাকা। বর্তমানে অবশ্য সে তুলনায় অনেকটাই পায়। কিন্তু কতটা? যেহেতু চাকরি নয়, মাস মাহিনার ব্যাপার নয়, কাজ না থাকল কোনো অর্থ জোটে না। আর্টকলেজের গ্রীষ্মের ছুটি প্রায় ২ মাস। পুজোর ছটি এক মাস। বড়দিনের ছুটি সহ অন্যান্য ছুটি রয়েছে। বার্ষিক প্রদর্শনীর জন্যও ছুটি থাকে। এই সময়ে এদের কিভাবে চলে খেউ খোঁজ রাখে? এরপর যদি শরীর খারাপ হয় সব গেল। আমি অনেক মডেল'কে জানি যারা ১৫/১৬ বছরে কলেজে এসেছিল মডেলিং করতে৷ আজ কারো বয়স ৬০, কারো ৬৫।  জীবনের মূল্যবান এই সময়টা ব্যয় করে বিনিময়ে কী পায় কতটুকু পায় জন আমরা ভেবে দেখেছি! এই করুন পরিস্থিতিকে না জেনে না বুঝে যখন মডেল নিয়ে মুখরোচক গপ্প ফাঁদা হয়, বা ঘ ভাড়া পাওয়া যায় না, তখন কী মনে হতে পারে!
যাক, এসব নিয়ে বলতে গেলে অনেক অপ্রিয় কথা বেরিয়ে আসবে। চাই না সেসব ঘাঁটতে। আপাতত এটুকুই। 


[ সঙ্গের সকল লাইফ-স্কেচ প্রদোষ পালের ছাত্র জীবনে আঁকা ]


 

No comments:

Post a Comment